আজ ক’দিন হলো উম্মে হুরায়রার মনটা একটুও ভালো নেই। মনের দুখে দুদিন স্কুলে যায়নি; এমনকি কোচিং ক্লাসও করেনি। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়াও করছে না। খেতে সাধলে বলে, ক্ষুধা লাগেনি। আর খেলতে ডাকলে বলে, কিসসু ভালো লাগে না। আবার জোর করে খাইয়ে দিলেও আম্মুর সাথে রাগ দেখিয়ে বলবে, কী সব রান্না করেছো? একটুও ভালো লাগে না…।
ঠিকই তো, ভালো লাগবে কেমন করে? আজ নিয়ে পাঁচদিন হলো ‘উম্মে হুরায়রা’র ‘হুরর’ মানে প্রিয় বিড়ালটা যে নিখোঁজ!
উম্মে হুরায়রাকে চিনলে না! উম্মে হুরায়রা আসলে আমাদের ছোট্ট সাবিহা মণির উপাধি। উপাধিটা তো আমাকেই দিতে হলো। সে কি আর না দিয়ে থাকতে পারি? কোথায় সাবিহা হবে ‘উম্মুল মহি’; তা না হয়ে সে কিনা আব্বুর চেয়ে তার বিড়ালটাকেই বেশি ভালোবাসে।
সারাদিন কেবল তিনু, তিনু আর তিনু। তিনুটাও হয়েছে তেমনি, ঘরের সবাই কাছে ডাকলে ফুড়–ত করে পালিয়ে যায় খাটের তলায়। অথবা সুড়–ত করে লুকিয়ে পড়ে সোফা কিংবা টেবিলের তলায়। অথচ সাবিহা ডাকলেই একেবারে গদগদ হয়ে মিঁউ মিঁউ ডাক ছেড়ে সোজা সাবিহার কোলে গিয়ে বসে।
রাতে সোজা ঢুকে পড়ে সাবিহার বিছানায়। তারপর সারারাত সাবিহার পায়ের কাছে ঘড়ঘড়.. ঘড়ঘড়.. ঘড়ঘড়… শব্দ করে আরামে নাক ডেকে ঘুমায়। আবার দিনে বা রাতে সাবিহা পড়তে বসলে তিনুটাও বেশ ‘শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ছাত্রটি’র মতো তার পাশটি ঘেঁষে বসে যায়।
আরও অবাক কা- হলো, তিনু কখনও কখনও সাবিহার বই-খাতা টেনে নিয়ে এমন ভঙিতে বসে- যেন, সিরিয়াস ছাত্রটি মনোযোগের সাথে লেখাপড়া নিয়ে মশগুল।
আচ্ছা এমন হুররকে কেউ কি আদর না করে থাকতে পারে? তাই ঘরের সবাই সাবিহার হুররটাকে মানে তিনু নামের বিড়ালটাকে খু-উ-ব… খু-উ-ব ভালোবাসে। সাবিহার মেজবোন ফারিহা তিনুকে নিয়ে তেমন মাতামাতি না করলেও মাঝ মাঝে ধরতে পেলে কোলে তুলে নেয়। আলতো করে আদর ঢেলে দেয়। আবার এটা ওটা খেতেও দেয়।
আর সাবিহার ভাইয়া তৌফিককে কিন্তু তিনুটা একদমই ভয় পায় না। ভাইয়া খেতে বসলেই তিনুটা সোজা গিয়ে তার পাশে মেহমান সেজে বসে যায়। ভাইয়াটাও তেমনি আর কী! নিজের প্লেটের খাবার থেকে খানিকটা ভাগ করে দেয় তিনুকে। আদুরে তিনুও বেশ আয়েশ করে নির্ভয়ে খাবারগুলো সাবাড় করে। শেষে ভাইয়ার পাশে বসেই হাত-মুখ চেটে চেটে ফ্রেশ হয়ে যায়।
অথচ আজ পাঁচ দিন, তিনুটা একেবারেই হাওয়া। কত বাসা-বাড়িতেই না খোঁজ করা হলো। পাড়া জুড়ে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করা হলো। না, তিনুটা নেই। নেই তো এক্কবারেই নেই।
ওদিকে তিনুর জন্য নির্ধারিত খাবার প্লেটটা মুখব্যাদান করে ফ্রিজের একপাশে পড়ে আছে। একটু একটু ধুলাবালিও জমেছে তাতে। তেমনি তিনুকে গোসল করাবার স্প্রে আর ছোট্ট শ্যাম্পুর বোতলটাও ওয়াশরুমের দরোজার একপাশে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। সাবিহার আম্মু অবশ্য ওগুলোকে উঠিয়ে গুছিয়ে রাখতে চেয়েছেন কয়েক বার। কিন্তু উম্মে হুরায়রার তাতে খুব আপত্তি। ও বলে, আরে রাখো তো আম্মু! ওসব দিয়ে আর কী করবো? আমার তিনুরই খোঁজ-খবর নেই…।
অবশ্য তিনু নিখোঁজ হবার পর থেকে যে উম্মে হুরায়রার আম্মুর মনটাও খুব ভালো নেই- তা কিন্তু খুব বোঝা যায়। বেচারি খেতে বসলেই বোনপ্লেটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন- আহারে বোনপ্লেটে এতোসব ঝুটাকাঁটা… কিন্তু কে খাবে আর এসব। তিনুটা যে কোথায় হারিয়ে গেলো…!
উম্মে হুরায়রার ভাইয়ার যত রাগ বাড়ির গেটের কালো কুকুরটার ওপর। তার ধারণা, এই হতচ্ছড়া কালো কুকুরটাই বিড়ালটাকে তাড়িয়েছে। কথাটা বিশ্বাস করার কারণও আছে। ভাইয়া প্রায়ই বিভিন্ন বিড়ালকে তাড়া করতে দেখেছেন ওই হতচ্ছড়া পাজি কুকুরটাকে। ওই হতভাগাটা যে তিনুকেও তাড়া করেনি- সে কথা আর হলফ করে বলবে কে?
এদিকে উম্মে হুরায়রার আম্মু কিন্তু চুপটি মেরে বসে নেই। তিনিও সকাল বিকাল মহল্লায় পায়চারি করে খবর নিচ্ছেন বিড়ালটার। কিন্তু কেউই বিড়ালটার সন্ধান দিতে পারেনি। তিনুকে নিয়ে উম্মে হুরায়রাদের ঘরে বেধেছে নতুন এক ঝামেলা। উম্মে হুরায়রার খুনখুনে বুড়োদাদু খেতে বসলেই ছোট্ট শিশুরমতো এদিক ওদিক তাকান। মনে মনে কী যেন খোঁজ করেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, সাবিহার তিনুটা কই? ওকে তোমরা আজ খাবার দিয়েছিলে তো?
দাদুকে বার বার বোঝানো হয়েছে- সাবিহার তিনু হারিয়ে গেছে। তিনুকে কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তার ওই এক অবস্থা। খেতে বসলেই ডাইনিং টেবিলের নিচে উঁকি মারবেন। ডানে-বাঁয়ে তাকাবেন। আর জিজ্ঞেস করবেন- সাবিহার তিনুটা কই? ওকে তোমরা আজ খাবার দিয়েছিলে তো? সাবিহা মানে উম্মে হুরায়রাকেই সামাল দেয়া মুশকিল। তার দাদুকে আর সামলাবে কে?
তিনুকে হারাবার পর থেকে সাবিহা প্রায়ই তিনুকে নিয়ে স্মৃতির জাবর কাটে। করুণ স্বরে বলে, কত কষ্ট করে তিনুকে বড় করলাম। ওর কত হাগু-মুতু পরিষ্কার করলাম। তিনুর জন্য তোমাদের কত বকা শুনলাম। আহারে, এখন বেচারা যেইনা নাদুসনুদুস হয়েছে… অমনি কোথায় হারিয়ে গেলো…।
সত্যি, তিনুর জন্মের পর থেকে ওর চোখ ফোটা পর্যবেক্ষণে সাবিহা বলতে গেলে সারাক্ষণই মেতে থাকতো। সাবিহার জ্বালায় তিনুর মা বিলু মানে আমাদের বড় বিড়ালটা প্রায়ই রেগে টম হয়ে যেত। এই বিলুকেও রাস্তা থেকে সেই একরত্তি বিড়ালছানা হিসেবে সাবিহাই কুড়িয়ে এনে আদর সোহাগ দিয়ে লালন-পালন করেছে। সেই বিলু বিড়ালের পুচকে ছানা তিনুকে নিয়ে সাবিহার উৎসাহে আর কমতি থাকবে কেন? তাই তো তিলে তিলে তিনুকেও লালন-পালন করতে কম করেনি সাবিহা। তিনু যখন সোফায় কিংবা কারও বিছানায় ইয়ে করে নষ্ট করে দিয়েছে, তখন সবার আঙুল ঘুরেছে সাবিহার ওপর। সবাই মিলে সাবিহাকে কম অপমান করেনি।
কিন্তু সাবিহা সেদিকে না তাকিয়ে, অপমানের জ্বালা থেকে বাঁচতে নিজহাতে তিনুর দুর্গন্ধময় ইয়েগুলো পরিষ্কার করেছে। কখনও নিজের টিফিনের টাকাটা বুয়ার হাতে গুজে বুয়াকে দিয়ে বিছানার চাদর অথবা সোফার কভার ধুইয়েছে। তবু তিনুর ওপর এত্তটুকুন রাগ করেনি।
এতোসব দেখে শুনে শেষ পর্যন্ত আমি গত জানুয়ারিতে নববর্ষের খেতাব হিসেবে সাবিহাকে ‘উম্মে হুরায়রা’ খেতাবটা দিয়েছিলাম। সেই থেকে কেবল যে বাসার সবাই তাকে উম্মে হুরায়রা ডাকে- তা কিন্তু নয়। সাবিহার বান্ধবীরাও এ কথা জেনে ফেলেছে। ওরাও মজা করে সাবিহাকে উম্মে হুরায়রা বলে ডাকে।
তিনু হারিয়ে গেছে শুনে ওদের মনেও অনেক কষ্ট। কিন্তু প্রিয় বান্ধবীকে তো প্রবোধ দিতে হবে। তাই তো দল বেঁধে এসে সাবিহার বান্ধবীরা ওকে সান্ত¡না দিয়ে গেছে। বলে গেছে- তুমি দেখে নিও উম্মে হুরায়রা! তিনু বেঁচে থাকলে একদিন তোমাদের বাসায় ফিরে আসবেই আসবে।

Share.

মন্তব্য করুন