প্রকৃতির একটু একটু পরিবর্তন ধরেছে। ইতোমধ্যেই শীতের আমেজ শেষ করে প্রকৃতি উঠেছে ফাগুনের সিঁড়িতে। চারদিকে ফুরফুরে বাতাস। আকাশে ছিটা-ছিটা মেঘ। সব মিলেই আজকের আবহাওয়াটা সুন্দর ও মনমুগ্ধকর। রুহান এমনি একটি দিনের প্রত্যাশা করছিলো বেশ কিছুদিন ধরে। সে আকাশে ঘুড়ি উড়ানোর প্র্যাকটিস করবে।
কারণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তাদের স্কুলে একটি প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠান আছে। আর ঐ অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণীয় আরেকটি প্রতিযোগিতার অংশে থাকবে আকাশে ঘুড়ি উড়ানো। এই অংশে শুধুমাত্র ক্লাস ফোর এর ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতে পারবে। তাই রুহানেরও একটা চান্স আছে। কারণ, সে এই বছর ক্লাস ফোরে এ উঠেছে।
আর পুরস্কার হিসেবে থাকবে একসেট আকর্ষণীয় গল্পের বই। প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানটি তাদের স্কুলে হয়ে আসছে।
রুহান তার বাবার কাছ থেকে তৈরি করা ঘুড়িটা নিয়ে তার ছোট বোন রুপাসহ বাড়ির পাশের একটা বড় মাঠে গেলো। মাঠের পাশেই ক্ষেত। নতুন ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। রুহান তার বোনকে বলল, ‘রূপা তুই ঘুড়িটা এভাবে ধরে থাকিস, আমি যখন তোকে বলবো যে ছেড়ে দে তখন আকাশের দিকে হাত ভাসিয়ে ছেড়ে দিবি কেমন।’
-ঠিক আছে। তাই করবো। তার ছোট বোন রুপা বলল।
রুহান তখন নাটাইটা হাতে নিয়ে সুতা ছাড়তে ছাড়তে প্রায় ৫০ হাত দূরে গেল।
– ছেড়ে দে রুপা। যেভাবে বলেছি।
রুপা তখন ঘুড়িটি উপরে ঝুঁকি দিয়ে উড়ে দিলো। ঘুড়ি উড়ে গেলো আকাশ পানে। আর নাটাই থেকে সুতো ছেড়ে দিতে লাগলো রুহান। আকাশে ঘুড়ি উড়া দেখে রুহান আর রুপা খুব খুশি। রুপা বলল,
– ভাইয়া, তুই পাবি।
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। বাবাও ডাকছে। পড়তে বসতে হবে। কালকে আবার ইংলিশ ক্লাস পরীক্ষা আছে। রুহান মনে মনে ভাবছে।
তাই নাটাইয়ে সুতা জড়াতে লাগলো। সুতা জড়ানো শেষ করে ঘুড়ি হাতে নিয়ে বাড়ি চলল রুহান আর ওর বোন। তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসলো দু’জনে। এশার নামাজ শেষ করে বাবা তাদের খেতে ডাকছে। খাওয়া শেষ করে রুপা বাবার সাথে ঘুমতে গেলো। রুহান বই খাতা নিয়ে টেবিলে পড়তে গেলো। কালকে তার ক্লাস পরীক্ষা আছে। সে ছাত্র হিসেবে অনেক মেধাবী ও বুদ্ধিবান। বরাবরই প্রথম হয়ে আসছে। পড়ালেখা শেষ করে বাবার পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়লো রুহান।
ফজরের আযান হচ্ছে। রুহান টের পেয়ে জেগে উঠলো। তার বাবাকে জেগে তুললো। তারপর নিজে ব্রাশ ও হাতমুখ পরিষ্কার করে পড়তে বসলো। রুপাও জেগে উঠে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসলো।
রুহান সকালের খাওয়া শেষ করে স্কুলে গেলো। বন্ধুরা সবাই এসেছে। সবাই আগামী পহেলা বৈশাখের কথা বলাবলি করছে। ঘুড়ি উড়ার কথাও অনেকে বলছে। রুহান নিশ্চুপ। কারণ, স্কুলে সে অযথা কথা বলে না। তার বন্ধুরা কাছে এলো। বলল,
-কি রে রুহান। ঘুড়ি উড়ার প্র্যাকটিস করছিস?
– হ্যাঁ। করছি। তোরা করছিস না?
– করছি, সবাই করছি।
বন্ধুরা সবাই ঘুড়ি উড়ানো প্র্যাকটিস করছে শুনে রুহান খুশি হলো। কারণ, ভালো প্রতিযোগীদের সাথে লড়তে প্রতি ক্ষেত্রেই ভালো লাগে রুহানের। ক্লাসের পড়া দিতে, ক্লাস পরীক্ষা, বার্ষিক পরীক্ষা সহ সকল ক্ষেত্রেই।
রুহান বলল, এবারের খেলাটি জমজমাটভাবে উদযাপন করতে চাই। কারণ, আমরা তো আর পরের বছর এই খেলায় অংশ নিতে পারবো না।
– কি বলিস তোরা?
– ঠিক বলেছিস রুহান। আমরা সবাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে খেলাটি খেলবো। দেখবো কার ঘুড়ি কত দূরে উড়তে পারে।
হঠাৎ বেলের আওয়াজ। ক্লাসে শিক্ষক এলেন। সালাম দিয়ে সবাই বসে পড়লো। রোল ডাকা হলো। এখন পরীক্ষা শুরু হলো। রুহান সহ ওর বন্ধুরা পরীক্ষা শেষ করে রুম থেকে বের হতে লাগলো। এমন সময় রুহান রুমের বারান্দা থেকে নামতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। তার বন্ধুরা তাকে তুললো। সে পায়ে প্রচুর ব্যথা পেয়েছে। হাঁটতেই পারছে না।
বেশ কিছুদিন ধরে স্কুলে যেতে পারছে না রুহান। এদিকে ঘনিয়ে আসছে পহেলা বৈশাখ। ঘনিয়ে আসছে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা। আর মাত্র দুইদিন বাকি।
রুহান আজ একটু সুস্থ। সে মনে মনে ভাবছে আমাকে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেই হবে। তাই বিকেলে সে তার ছোট বোন রুপাকে নিয়ে মাঠে গেল ঘুড়ি উড়া প্র্যাকটিস করতে। প্র্যাকটিস শেষ করে বাড়ি এলো। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসলো।
পরের দিন রুহান ঘুম থেকে উঠে দেখলো, সে পুরোপুরি সুস্থ। তাই সে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। বাবা বলল,
-রুহান তোমাকে রেখে আসবো কি?
-না, লাগবে না বাবা। যেতে পারবো।
– আচ্ছা, দেখেশুনে যেও?
রুহানকে দেখে স্কুলের বন্ধুরা সবাই খুশি। সবাই বলল,
– রুহান ভালো আছিস?
– এই তো ভালো আছি। তোরা?
– আমরাও ভালো আছি।
আগামী কালের প্রস্তুতি নিয়ে সবাই কথা বলছে। হঠাৎ স্কুলের বেল বেজে উঠলো। শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশ করলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এক সময় শিক্ষক জানতে চাইলেন,
– তোমাদের প্রস্তুতি কেমন?
– জি। ভালো স্যার (সবাই সমস্বরে বলল)।
এভাবে ক্লাসগুলো কেটে গেলো। স্কুল ছুটি হলো। রুহান বাড়ি এলো। গত দিনের মত আজও বিকেলে ঘুড়ি প্র্যাকটিসে বের হলো রুহান। প্র্যাকটিস শেষ করে বাড়ি ফিরলো রুহান। যথাযথ রুটিন মাফিক শুরু করলো তার পড়ালেখা। পড়ালেখা শেষ করে বাবা ও রুপার সাথে খেয়ে নিলো। খাওয়ার পর সবাই ঘুমাতে গেলো। রুহানের কোন মতেই ঘুম আসছে না। মনে টানটান উত্তেজনা আর উচ্ছ্বাস। হঠাৎ বাবা বলল,
– রুহান, তোমার প্রতিযোগিতার কি অবস্থা? সব প্রস্তুতি ঠিকঠাক আছে তো?
-জি বাবা। প্রস্তুতি ভালোই আছে। বাকিটা আল্লাহ্ হাওলা।
– ধন্যবাদ রুহান। তোমার জন্য দোয়া করি।
– ধন্যবাদ বাবা।
বাবার কথায় একটু স্বস্তি ও সাহস পেল রুহান। তারপর আনন্দে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে নিজেও জানে না। ফজরের আযান শুনে ঘুম ভাঙলো রুহানের। জেগে উঠলো সে। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসল। কি আর পড়বে! কিছু বুঝে আসছে না। বাবাও নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলো। রুহানের মনে একদিকে আনন্দ আরেক দিকে হতাশা। কারণ, আমি কি পারবো জয়ী হতে ইত্যাদি।
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটায় ৮টা বেজে গেলো। এখন স্কুলে যাওয়ার পালা। তাই গোসল করে স্কুলের পোশাক পরে নিজেকে তৈরি করলো রুহান। সাথে তার বোনকেও নিয়ে যাবে সে। দাবি করলো বাবার কাছে। বাবা রাজি। দু’জনে খেয়ে নিলো এবং স্কুলের উদ্দেশে বের হলো।
যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছল ওরা। স্কুল আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য অনেক মানুষের ভিড় জমেছে। রুহান রুপাকে নিয়ে তার ক্লাসে গেলো। রুহান তার বন্ধুদের সাথে তার বোনকে পরিচয় করে দিলো। রুহান তাদের বলল,
– আমাদের পর্ব কখন শুরু হবে, কেউ জানো কি?
– এগারটায় শুরু হবে। এগারটা থেকে বারটা এক ঘণ্টা। বাপ্পি বলল।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
এখনও এক ঘণ্টা বাকি। তাই তারা নানা গল্প করে কাটিয়ে দেবে। ভাবলো সবাই।
গল্প করতে করতে হঠাৎ মাইকে ডাক পড়লো এখন এ পর্যায়ে আজকের এই অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্রদের ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা। তাই তোমরা মাঠে নিজ নিজ ঘুড়ি নিয়ে প্রবেশ করো। বললেন অনুষ্ঠান পরিচালক জাহিদ স্যার।
তবে কথা হলো একটি ঘুড়ির সাথে দু’জন থাকবে। একজন নাটাই ধরবে। আরেকজন ঘুড়ি উড়িয়ে দেবে আকাশে। দশটি ঘুড়ি নিয়ে বিশজনের প্রতিযোগিতা। যে কোন দু’জন পাবে পুরস্কার। যাদের ঘুড়ি সবার উপরে থাকবে তারাই। ঠিক এগারটায় শুরু হলো খেলা। লাল নীল রং এর রঙিন ঘুড়িগুলো উড়ে গেলো আকাশে। দারুণ লাগছে মাঠের আকাশটির দৃশ্য। হাত তালিতে মুখরিত পুরো মাঠ। ইতোমধ্যেই চারটি ঘুড়ি ছিঁড়ে গেছে। দুইটি নিচে পড়ে গেছে। আর মাত্র চারটি ঘুড়ি উড়ছে আকাশে।
ফুরফুরে বাতাস। উড়ছে ঘুড়ি। সবাই হাততালি দিচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ দুইটি ঘুড়ি সুতোয়-সুতোয় পাক খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর মাত্র দুইটি ঘুড়ি। টানটান উত্তেজনার মাঝখানে রুপা চিৎকার করে বলল,
– ভাইয়া, আরেকটু সুতো ছাড়!
রুহান তখন দেখলো সত্যিই তো, ওটাকে কাটাতে হলে আরেকটু সুতা ছাড়তে হবে। তখন সুতা ছাড়তে লাগলো রুহান আর বলল,
– বোন, তোকে ধন্যবাদ।
পাশের বন্ধুর নাটাইয়ের সুতা শেষ হয়ে যাওয়ায় আর উপরে উঠতে পারছে না তার ঘুড়িটি। এদিকে রুহানের ঘুড়ি তার ঘুড়িকে নিচে ফেলে বহুদূরে উড়ছে। সবার হাততালিতে মুখরিত মাঠ। সবাই রুহান রুহান বলে চিৎকার করছে।
এমন সময় মাইকে ঘোষণা হলো যে, আজকের এই আকর্ষণীয় পর্বে সেরা বিজয়ী চতুর্থ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র রু-হা-ন। রুহান তখন দৌড়ে বাইরে এসে তার বোনকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরতে থাকলো। রুহানকে পুরস্কার তুলে দিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. ইমরোজ খালিদ। পুরস্কার পেয়ে দুই ভাইবোন মহাখুশিতে বাড়ি ফিরলো। বাবাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরলো রুহান। বাবা তোমার দোয়া সফল হয়েছে। আমি আজ সেরা বিজয়ী হয়েছি। ছেলের মুখে এসব কথা শুনে একদিকে আনন্দ আরেক দিকে বেদনার রেখাপাত ঘটলো তার অন্তরে। বাবা বললেন,
– আজ যদি তোদের মা বেঁচে থাকতো। তাহলে আমার চেয়ে অনেক খুশি হতো। আমার আগেই তোমাদের কোলে তুলে নিতো।
– মনটা খারাপ হয়ে গেলো রুহানের।
ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। তাই ওরা হাতমুখ ধুয়ে বাবার সাথে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ করে রুহান।
আর রুপা বাবার সাথে ঘুমোতে গেলো। আজকের দিনটি কেমন কাটলো তা বাবাকে বলতে বলতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লো রুহান।

Share.

মন্তব্য করুন