ঈদ একটি আরবি শব্দ। ঈদ মানে আনন্দ; ঈদ মানে খুশি। আর,এই ঈদটাই হচ্ছে অনেক মূল্যবান ইবাদত। আনন্দ ও ফূর্তি করার মাধ্যমে যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ-ই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ঈদের সামাজিক অর্থ-উৎসব আর আভিধানিক অর্থ-ফিরে আসা। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের তাঁর দেয়া নেয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করে থাকেন। ছদকায়ে ফিতর, হজ্জ-জিয়ারত, কুরবানির গোশত ইত্যাদি নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বারবার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নেয়ামত ফিরে পেয়ে মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে। যা বছরে দুটি ঈদ উৎসব এর মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করে থাকি। একটি হচ্ছে-ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ আর অন্যটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ। ঈদুল আযহাতে করতে হয় ধনীদের আর্থিক ত্যাগ আর ঈদুল ফিতরে করতে হয় সবলদের দৈহিক ত্যাগ। আর এ দুটি ঈদই মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল আযহা অনুষ্ঠিত হয় জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে আর ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের এক তারিখে।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে মদীনাবাসীগণ ‘সিহিরজান’ ও ’নওরোজ’ নামে দুটি উৎসব পালন করতো। মহানবী(স.) এ দুটি দিন সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে-এ দিনে তারা খেলাধূলা ও আমোদ-প্রমোদ করে। তখন মহানবী(স.) তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো এই তাৎপর্য্যপূর্ণ দুটি ঈদ সম্পর্কে বললেন। যেখানে মদীনাবাসীগণ শুধুমাত্র খেলাধূলা ও আনন্দ ফূর্তির মাধ্যমে দিন দুটি কাটাতো, আল্লাহতায়ালা সেখানে এমন দুটি দিন রহমত স্বরূপ দান করলেন- যে দিনে আল্লাহর শোকর গোজার, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ, শালীন ও নিয়ন্ত্রিত আনন্দ-ফুর্তি,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও যতটুকু সম্ভব নতুন কাপড়-চোপড় পরিধান করা, ভালো খাবার দাবার গ্রহণ ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া-আসা, তাদের খোঁজ-খবর নেয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা হবে।

আমরা আজকে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ সম্পর্কে আলোচনা করবো। ‘ফিতরা’ শব্দটি থেকে এসেছে ফিতর। যার অর্থ দান-খয়রাত করা। সুতরাং ঈদুল ফিতর এর মানে হচ্ছে-দান খয়রাত করে পবিত্র ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করার মাধ্যমে উৎসবে পরিণত করা। দান-খয়রাতের মাধ্যমে ধনী-গরীবের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পারস্পরিক ভেদাভেদ দূর হয়। সমাজে সুখ ও শান্তি বিরাজ করে।
সাম্য ও ভ্রাতৃতের¡ মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রসারিত করাই হচ্ছে ঈদের শিক্ষা। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে সামাজিকতা ও মানবতাবোধকে সমুন্নত করাই হচ্ছে ঈদের মূল তাৎপর্য। ঈদুল ফিতরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দান-খয়রাত করা। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানদের ঈদের দিন ফিতরা দেয়া অবশ্য কর্তব্য। আর এজন্যই এ ঈদের নাম ঈদুল ফিতর। ধনী-গরীব কেউ-ই যাতে এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়,সে জন্যই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
এই ঈদ সম্পর্কে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন অনেক জনপ্রিয় ও মনোমুগ্ধকর একটি গান। যা প্রত্যেক রোজার ঈদ এলে আমরা প্রাণভরে গাইতে থাকি। এতে আমাদের ঈদের আনন্দ আরো অনেকগুন বেড়ে যায়।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত দুশমন হাত মিলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।’
এভাবে কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের লিখনীতে আমাদের ঈদের আনন্দ আরো বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ঈদ আমাদের জন্য অনেক বড় নেয়ামত। ঈদের সময় আমাদের কিছু করণীয় বিষয় আছে। চলুন,আমরা জেনে নেই সেসব বিষয়গুলো।
১. মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি ’তাকবির’ বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঈদ উৎসব শুরু হয়। ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে এ তাকবির পাঠ করতে হবে। তাকবিরের ভাষা হচ্ছে- ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার; ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। এর অর্থ হচ্ছে- ‘আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহ শ্রেষ্ঠ,আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা’। এ তাকবীর ধ্বনি পুরুষরা বলবে জোরে জোরে আর মহিলারা আস্তে আস্তে।
২. ঈদের দিনে ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়ার ফজিলত অনেক। তাই আমাদেরকে ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়ার চেষ্টা করতে হবে।
৩. ঈদের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে-ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করা।
৪. ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে গোসল করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। নতুন বা পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে।
৫. ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে কিছু খাবার খেয়ে বের হওয়া এবং ঈদুল আযহার দিনে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানীর গোশত দিয়ে খাবার খাওয়া সুন্নত।
৬. হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। সবাইকে সালাম ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে এক রাস্তায় যাওয়া ও অন্য রাস্তায় ফিরে আসা সুন্নত।
৭. রমযান মাসে রোজার ভুল-ত্রুটি পূরণ করতে এবং অভাবগ্রস্থদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত পরিমাণ ফিতরাহ দান করতে হবে।
৮. ঈদের দিনে সবাইকে খুতবা শুনতে হবে।

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পরে আসে ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের দিন আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের সব গুনাহ মাফ করে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘রোজা আমার জন্য, তাই আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। কবির ভাষায়-
‘সেহরী খেয়ে যায় নামাজে
দিনের বেলা খায় না মাঝে
কষ্ট আহা কী যে!
এর বিনিময় দেবেন রে ভাই
আল্লাহ তায়ালা নিজে।’

তাই ঈদের দিনে আমাদেরকে আল্লাহর কাছে সমস্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের জন্য দোয়া করতে হবে। আল্লাহ যেন তাদের পরকালীন জীবন শান্তির করে দেন। বিশেষ করে, সিরিয়া, মিশর ও মায়ানমারসহ যেসব দেশের মানুষেরা নির্যাতিত তাদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। আল্লাহ যেন তাদের সহায় হোন। নির্যাতনকারীদের যেন আল্লাহ হেদায়াত দান করেন। আমাদের নবী-রাসূলগন ঈদের দিনে বেশি বেশি দান-খয়রাত করতেন। অসহায়-দরিদ্র মানুষদের খোঁজ-খবর নিতেন। সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তাই আমাদেরকেও তাদের পথ অনুসরণ করতে হবে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,
‘সত্যিকারের ঈদের খুশি যদি পেতে চাও
ঈদ আসে নি কার ঘরেতে খবর নিতে যাও’।

তাই অসহায়-বঞ্চিত মানুষদের খোঁজ-খবর নিতে হবে। সাধ্যমত তাদেরকে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। সর্বোপরি, যেসব কাজ করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় সেসব কাজ আমাদেরকে বেশি বেশি করতে হবে। তবেই আমরা ঈদের পরিপূর্ণ ফজিলত লাভ করতে পারবো এবং আমাদের জীবন আরো সুন্দর হবে। আমাদের উচিত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ ও শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে ঈদ উদযাপন করা। সবাইকে ঈদ মোবারক!

Share.

মন্তব্য করুন