দাদু রাইয়ানের কান্না কিছুতেই থামাতে পারছেন না। তার অতি পছন্দের সুইংগাম সাধছেন। ব্যাট-বল হাতে নিয়ে ক্রিকেট খেলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তাও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রাইয়ান কাঁদছে। আর হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে বলছে, খাবো না আমি। কিছুই খাবো না। খেলবোও না। আমার তো কোনো স্বাধীনতা নেই। কিছুই করবো না আমি।
রাইয়ানের কান্নাজড়িত কথা শুনে দাদু এবার স্তম্ভিত হয়ে যান। এতটুকুন শিশুর মুখে তিনি একি শুনছেন? মাত্র পাঁচে পা দিয়েছে রাইয়ান। আসছে জানুয়ারিতে স্কুলে ভর্তির জন্য ওর মা বেশ তৎপরতা শুরু করেছে। আর এই এত্তটুকুন ছেলে কি না তার স্বাধীনতার কথা বলছে! দাদু এবার রাইয়ানের পাশে বসে তার মাথার চুলে আঙুল ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আদরমাখা কণ্ঠে বলেন, আমার দাদু সোনা- কে বলেছে তোমার স্বাধীনতা নেই। অবশ্যই আছে।
দাদুর আদরমাখা ডাকে রাইয়ান এবার মুখ তুলে বলে, না দাদু আমার কোনো স্বাধীনতা নেই। দাদু এবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে রাইয়ানের চোখ দুটো মুছে টেনে কোলে তুলে নেন। কপালে আলতো করে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলেন, কেন তুমি স্বাধীনতার জন্য কাঁদছো? কে তোমার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে আমায় খুলে বলো তো শুনি দাদুভাই।
রাইয়ান এবার দাদুর কোলে আরাম করে বসে আদরে গদগদ হয়ে বলে, তুমি তো কাল আমায় স্বাধীনতার গল্প বলেছো। তোমরা যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছো। তুমি তো বলেছো, স্বাধীনতা মানে নিজের ইচ্ছেমতো চলা, যা খুশি তাই করা। বলোনি?
– হ্যাঁ বলেছিতো? স্বাধীনতা তো এমনি।
– তাহলে বলো আম্মু তো আমাকে কিছুই করতে দেয় না। সব সময় বলে, রাইয়ান এটা করো না, ওটা ধরো না, ওদিকে যেও না। তাহলে আমার স্বাধীনতাটা কোথায়? ওই যে আমাদের ছোট্ট পুষি বিড়ালটা তারও স্বাধীনতা আছে। সারাক্ষণই এ ঘর থেকে ও ঘরে ছোটাছুটি করে। লাফিয়ে জানালার ওপরে ওঠে। বারান্দায় যায়। আর আমি একটু খেলতে গেলেই আম্মু মানা করে। আম্মু শুধু খেতে বলে। আমার এসব একদম ভাল্লাগে না। আদরে অভিমানে রাইয়ানের কণ্ঠ আবারও কাঁদো কাঁদো মনে হয়।
– দাদু বিস্ময়ে হতবাক। ছোট্ট এই শিশুর মুখে তিনি আজ স্বাধীনতার কথা শুনছেন। একদিন নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতা শব্দটা তার কাছে অতিপ্রিয়। দাদু এবার রাইয়ানের চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুলে ধরে একটু মুচকি হেসে বলেন, সত্যিতো আমার দাদু ভাইয়ের স্বাধীনতা এভাবে কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা কিভাবে অর্জন করতে হয় আমি তা জানি। দাঁড়াও এখনই আমি তোমার আম্মুকে বলে দিচ্ছি। আর যেন তোমার স্বাধীনতায় কোনো বাধা না দেয়।
– জি¦ দাদু, এখনই তুমি আম্মুকে ডেকে বলে দাও। রাইয়ানের মুখে এবার হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এখন থেকে সে ইচ্ছামতো সব কিছু করতে পারবে।
– হ্যাঁ এখনই বলবো। তার আগে এই স্বাধীনতা নিয়ে তোমাকে আরও কিছু কথা বলি তুমি তা মন দিয়ে শোনো।
– জি¦, বলো দাদু।
গল্প শুনতে খুবই পছন্দ করে রাইয়ান। দাদু তাকে গল্প বলেন বলেই তিনি তার খুব প্রিয়। প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে রাইয়ান দাদুর কাছে গল্প শুনতে চলে আসে। দাদুর পাশে শুয়ে ভূতের গল্প, পরীর গল্প, দৈত্য-রাক্ষস, রাজা-রানী এসবের গল্প শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। গতকাল দাদু তাকে স্বাধীনতার গল্প বলেছেন। কিভাবে তারা পাকিস্তানি দৈত্য-দানবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। গর্ব আর অহংকারের সেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প তিনি করেছেন।
রাইয়ানকে নিয়ে দাদু এবার ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসে বলেন, শোনো দাদুভাই স্বাধীনতার সাথে অধিকার, নিয়ম, শৃংখলা এ শব্দগুলো জড়িত। নিয়ম ভেঙে ইচ্ছামতো যা খুশি করা সেটা স্বাধীনতা নয়। এটাকে স্বেচ্ছাচারিতা বলে। তাই স্বাধীনতা ভোগ করতে হলে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। তুমিও যদি বাবা-মায়ের কথা না শুনে ইচ্ছামতো যা খুশি তা করো তাহলে সেটা হবে স্বেচ্ছাচারিতা। বাবা- মায়ের কথা শুনে নিয়মমতো পড়ার সময় পড়া, খাওয়ার সময় খাওয়া এবং খেলার সময় খেলা করাই হলো সত্যিকারের স্বাধীনতা। বুঝেছো?
রাইয়ান মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। দাদু রাইয়ানের গালে আলতো চুমু খেয়ে আদর করে বলেন, তাহলে এখন থেকে আমার দাদুভাই মায়ের কথামতো খাবে, সময়মতো ঘুমাবে তাই না? রাইয়ান মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে দাদুর কথায় সম্মতি জানায়। এ সময় রাইয়ানের আম্মু ডাকতে ডাকতে খাবার নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে। রাইয়ানের আম্মুকে দেখেই দাদু বলেন- শোনো বউমা, এবার থেকে আমার দাদুভাইকে তার স্বাধীনতা নিয়ে চলতে দিতে হবে। আর দাদুভাই স্বাধীনতা মানে তো নিয়ম মেনে চলা তাই না? জি¦ বলে রাইয়ান উত্তর দেয়। দাদু এবার মুচকি হেসে বলেন তাহলে এবার ঝটপট খেয়ে নাও। তারপর দু’জনে মিলে ক্রিকেট খেলবো। খেলার কথা শুনে রাইয়ান এবার দাদুর কোল থেকে নেমে ‘হুররে…’ বলে নাচতে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন