সে বহুকাল পূর্বে আরব উপদ্বীপের এক ধনী ব্যক্তির বিশ্বস্ত এক কেনা গোলাম ছিলো। মনিবের প্রতিটি নির্দেশ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। সহায়-সম্পত্তি চোখে চোখে রাখতো। মনিবের ছেলে-মেয়েদের নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতো। কখনো তাদের ক্ষতি হতে দিতো না। নৌবাণিজ্যে যাবার পথে হঠাৎ ধনি ব্যক্তির একমাত্র পুত্র পানিতে পড়ে মারা যাওয়ার অবস্থা। কেনা গোলামটি খর স্রোতা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে ছেলেটিকে উদ্ধার করে। এতে মনিব খুশি হয়ে গোলামটিকে আজাদ করে দেন।
শুধু মুক্তি নয়; ধনী ব্যক্তিটি একটি পালতোলা জাহাজে অনেক উপহার, অনেক মালপত্র বোঝাই করে তাকে দান করেন। কেনা গোলামটি ভাবলো, সে একা, এতোসব মালপত্র দিয়ে কী করবে? বরং ব্যবসা-বাণিজ্য করে আরো লাভবান হতে পারলে নিজ দেশে ফিরে যাবে। ঘরসংসার করে এক জায়গায় থিতু হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কেনা গোলাম সেই মালবোঝাই জাহাজ নিয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মাত্র কয়েকদিনের পথ পাড়ি দিতেই সমুদ্রের প্রচন্ড ঝড়ে তার জাহাজটি লোকজন আর মালামালসহ ডুবে গেলো। কে কোথায় হারিয়ে গেলো তা কেউ জানে না। কেনা গোলামটি একটি কাঠের গুঁড়ি ধরে কোনোমতে ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলো। মরার মতো উপকূলে পড়ে থাকলো পুরো একদিন একরাত। সকালে নতুন সূর্যের তাপ চোখে মুখে লেগে কেনা গোলামের ঘুম ভাঙলো। অনেক কষ্টে, ক্ষুধা ও যন্ত্রণায় কাতর গোলামটি নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। সামনে ধু ধু চর। দূরে সবুজ গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। পা চলে না। শরীর ভেঙে পড়ে যেতে চায়। তবুও সে মনের জোরে পা বাড়ায়। মনে তার অনেক আশা। হয়তো এই দ্বীপে মানুষজন বাস করে। সে নিশ্চয়ই কোনো জনপদে গিয়ে হাজির হবে। তার দুঃখের অবসান হবে।
স্বপ্ন তার সত্যি হলো। উপকূল থেকে কিছুদূর অগ্রসর হতেই দেখলো গাছগাছালি পাখপাখালি ছাড়িয়ে আকাশছোঁয়া এক রাজপ্রাসাদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখলো চারিদিক লোকে লোকারণ্য। কেনা গোলামটির পরনে সামান্য একটুকু ছেঁড়া ন্যাকড়া। কোনোমতে লজ্জা ঢেকে রেখেছে। তার পা আর সামনে চলে না। মাথা হেঁট হয়ে আসে। কারণ একটু দূরে যে শত শত লোক তার দিকে তাকিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সবার পরনে নামিদামি ঝকঝকে তকতকে কারুকার্যময় পোশাক। লজ্জায় নত মুখে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। লোকজনের অপেক্ষা আর সইলো না। তারা হৈ চৈ করে তার দিকে ছুটে এলো। সমস্বরে জয়ধ্বনি করে উঠলো, কে এসেছেন? বাদশাহ্ এসেছেন। শুভেচ্ছা স্বাগতম- নতুন বাদশাহ্ আস্সালাম। আসুন জাহাঁপনা। আমরা আপনার জন্যই এখানে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি।
কেনা গোলামটি ভাবলো, লোকগুলো তার সাথে কী নিষ্ঠুর হাসি ঠাট্টা করছে। সমুদ্র ঝড়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকার লড়াইতেও সে এতো কষ্ট পায়নি। লজ্জায় মনে হচ্ছিলো, মাটি ফাটুক সে তৎক্ষণাৎ তাতে লুকিয়ে পড়বে। না হাসি ঠাট্টা নয়; লোকজন লেংটি পরা কেনা গোলামকে একসাথে রাজকীয় সালাম জানালো। রাজপ্রাসাদে নহবত বেজে উঠলো। রঙিন পতাকা পতপত করে উড়তে লাগলো। রাজকর্মকর্তা-কর্মচারীগণ কেনা গোলামটিকে অত্যন্ত আদরের সাথে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলো। হাম্মামখানায় নিয়ে উত্তমরূপে গোসল করালো। রাজপোশাক পরিয়ে মাথায় রাজমুকুট পরালো। শেষে সানাই বাজিয়ে পাত্রমিত্র অমাত্যবর্গসহ বাদশাহ্র দরবার হলে কেনা গোলামটিকে নিয়ে পৌঁছালো। প্রধান উজিরসহ কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী তাকে আদবের সাথে বাদশাহ্র জন্য রক্ষিত ময়ূর সিংহাসনে বসিয়ে দিলো।
কেনা গোলাম হয়ে গেলেন পুরোপুরি বাদশাহ্। তার মাথায় কারুকার্যময় স্বর্ণমণিমুক্তা খচিত রাজমুকট শোভা পেতে লাগলো। খুব সুন্দর লাগছিলো তাকে। গোটা রাজদরবার খুশি আর আনন্দে ভরে উঠলো। বাদশাহ্র সম্মান দিতে এই নতুন দ্বীপবাসী একটুকুও কার্পণ্য করলো না। তাঁর সম্মান ও আদর-আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি হলো না। কেনা গোলাম একেবারে স্তম্ভিত। সে জেগে আছে না স্বপ্ন দেখছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
দরবার হল একেবারে নিস্তব্ধ। কোথাও এতোটুকুন সাড়া শব্দ নেই। সবাই ভেবেছিলো নতুন বাদশাহ্ তাদের সালামের জবাব দেবেন। খুশিতে আটখানা হয়ে নানা কথা বলবেন। তাদের সুবচন শোনাবেন। না তিনি কিছুই বললেন না। দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকার পর কিছুটা বেসামাল ব্যক্তির মতো কড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপার কী? তোমরা আমার মতো বিপদগ্রস্ত পথের ফকিরকে ধরে এনে বাদশাহ্ বানালে কেন? আমি কে, কী আমার পরিচয়? একটি বারের জন্যও তা জিজ্ঞেস করলে না। তোমরা কি সবাই পাগল? দ্বীপবাসী সবাই কি একত্রে ক্ষেপে গিয়েছো?’
তারা সমস্বরে জবাব দিলো, না জাহাঁপনা, আমরা ক্ষেপিনি। আপনার সাথে হাসিঠাট্টাও করিনি। আপনাকে সসম্মানে আমাদের বাদশাহ্ বানিয়েছি। কেনা গোলাম কিছুটা শান্ত হয়ে বললো, ‘তবে প্রধান উজির বলুন, কেন এ অবস্থা? কেন এ ব্যবস্থা?’ উজিরে আজম বললেন, ‘আমরা প্রতি বছর আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করি, হে মাবুদ! আমাদের একজন বাদশাহ্ দিন। মহান আল্লাহ্ আমাদের ফরিয়াদ মঞ্জুর করেন। প্রতি বছরই তিনি একজন বাদশাহ্কে আমাদের ওপর শাসনকার্য পরিচালনার জন্য পাঠান। এবার আপনি এসেছেন। আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কাঙাল হোন, মূর্খ হোন, হীনজন্মা হোন, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আল্লাহ্ যখন আপনাকে পাঠিয়েছেন তখন আপনি এক বছরের জন্য আমাদের বাদশাহ্। আপনার আদেশ আমাদের শিরোধার্য।’
কেনা গোলাম খুব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এক বছর পর আমার কী গতি হবে?’
‘অন্যান্য বাদশাহ্র যে গতি হয়েছে, তাই হবে?’ বললেন উজিরে আজম।
‘মানে!’
‘মানে, এক বছর পর সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে এক কাপড়ে একটি জাহাজে চড়িয়ে আপনাকে অন্য একটি নির্জন দ্বীপে ফেলে আসা হবে।’
‘ও আচ্ছা, তাই!’
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘যারা আগে বাদশাহ্ ছিলেন, তারা এ কঠিন অবস্থা হতে পরিত্রাণের কোনো ব্যবস্থা করেননি?’
কেউ না। সবাই আনন্দ ফুর্তিতে আর ভোগবিলাসে দিন কাটিয়েছেন। বছর শেষে তার কী হবে, সে কথা কেউই ভাবেননি। শেষ দিনটিতে প্রথানুযায়ী তাদের যখন এক কাপড়ে বিদায় জানাতে আসি তখন তারা প্রত্যেকেই কেঁদে আকুল হয়েছেন। অনেক কাকুতি মিনতি করেছেন। কোনো লাভ হয়নি। আমাদের রাজপ্রাসাদ আর দ্বীপ থেকে তাকে চোখের পানিতে বিদায় নিতে হয়েছে।’
কিছুক্ষণের জন্য পুরো দরবার নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো। কেনা গোলামের মুখের ভাষা কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। উপস্থিত অমাত্যবর্গের মুখেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। গোলামের চোখ গিয়ে পড়লো শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুধারী এক জ্ঞানী ব্যক্তির প্রতি। কেনা গোলাম জ্ঞানী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি বলুন দেখি, যখন নির্জন দ্বীপে আমাকে নির্বাসনে পাঠানো হবে, তখন কী করলে আমি চরম দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো?’
‘উপায় আছে। কিন্তু সে জন্য এতো তাড়াতাড়ি কেন? কিছুকাল আনন্দ উপভোগ করুন। দু’মাস আগে হতে ব্যবস্থা নিলেই চলবে।’
‘না, আমার ভোগে কাজ নেই। আজ হতেই আমি ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করতে চাই। এ জন্য কী করতে হবে বলুন।’
‘যে নির্জন দ্বীপে আপনাকে নির্বাসন দেয়া হবে, এখন থেকে সেই দ্বীপে লোকজন পাঠিয়ে নগরীর গোড়াপত্তন করুন। নগর গড়ে তোলার লক্ষ্যে বনজঙ্গল ছাপ করুন। জমিতে চাষবাসের ব্যবস্থা করুন। লোকজন দিয়ে বসতি গড়ে তুলুন। আপনি বছরের শেষে যখন এদেশের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে নতুন দ্বীপে যাবেন, তখন সেখানেও আপনি বাদশাহ্রূপে গমন করবেন।’
‘তা কী করে সম্ভব?’
‘অবশ্যই সম্ভব। আপনি আমাদের বাদশাহ্। আপনি যা আদেশ দিবেন, তা মান্য করতে আমরা বাধ্য। লোকদের যা নির্দেশ দিবেন, লোকেরা তাই পালন করবে। কোনো ত্রুটি করবে না।
আজই আমি সেখানে লোক পাঠাচ্ছি। যতদিন সেখানে চাষবাস ও লোকবসতি গড়ে তুলতে না পারি, ততদিন এ বাদশাহী, এ ভোগবিলাস, এ আনন্দ ফুর্তি আমি ত্যাগ করলাম। আমি আপনাদের বাদশাহ্ নই, এক নগণ্য খাদেম।’
কেনা গোলাম কী যেন ভেবে আবার চিন্তিত হয়ে পড়লো। একটু পরে জ্ঞানী লোকটিকে উদ্দেশ করে বললো-
‘আচ্ছা! আপনি আমাকে যে উপদেশ দিলেন, তা কি আগেকার অন্য বাদশাহ্দের দেননি?’
‘হ্যাঁ দিয়েছি বৈকি! কিন্তু তারা বলতেন, ওসব কথা এখন থাক। দু’মাস আগে থেকে ব্যবস্থা করলেই হবে। এরপর তারা সারাক্ষণ এমনভাবে আনন্দভ্রমণ আর ভোগবিলাসে ডুবে থাকতেন যে, বছর কখন ফুরিয়ে গিয়েছে তা তারা টেরই পেতেন না। পরিণামে যা হবার তাই হয়েছে। হতাশা আর দুঃখ যন্ত্রণার রোষানলে পুড়ে তারা অঙ্গার হয়েছেন।’
জ্ঞানীর উপদেশ মতো কেনা গোলাম সব ব্যবস্থাই করলো। নতুন দ্বীপে লোক পাঠালো। ঝোপ-জঙ্গল ছাপ করলো। চাষবাসের ব্যবস্থা করলো। ঘরবাড়ি তৈরি করলো। পুকুর কাটলো, দিঘি কাটলো, ফলের বাগান বানালো। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে একটি সুন্দর রাজপ্রাসাদও তৈরি করলো। এসব তৈরি করতে গিয়ে কেনা গোলামের একটুও অবসর ছিলো না। সুখ-সম্ভোগ আনন্দ ফুর্তি কাকে বলে তা সে একটুও অনুভব করলো না। শুধু কাজ আর কাজ। নতুন দ্বীপে নতুন বাদশাহ্ রূপে গমনের চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলো। প্রস্তুতি নিলো কোমর বেঁধে। বছর ফুরিয়ে এলো। কেনা গোলামের হৃদয়ে খুশির বন্যা বইলো।
ঠিক এর বিপরীতে পূর্বের বাদশাহ্রা ভয়-ভীতিতে বেসামাল হয়ে পড়তো। পরিণাম ভেবে কেঁদে কেটে মন্ত্রী আর দ্বীপবাসীকে করজোড়ে নিবেদন করতো, তাদের যেন নির্বাসনে না পাঠানো হয়। অন্তত কয়েক মাস তাদের শাসন ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো হয়। যাতে তারা নতুন দ্বীপে বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু না, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। নির্ধারিত সময়ে তাদের শূন্যহস্তে এক বস্ত্রে এ দ্বীপ থেকে বিদায় নিতে হয়।
শেষ দিন এসে হাজির। রাজমুকুট, রাজপোশাক, রাজসিংহাসন কেড়ে নেয়া হলো। যে অসহায় অবস্থা এ দ্বীপে এসেছিল ঠিক সেরূপ এক কাপড়ে ভাঙা জাহাজে কেনা গোলামকে তুলে দেয়া হলো। না; কেনা গোলামের কপালে কোনো দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েনি। মুখও মলিন হয়নি। মনে নেই কোনো ভয়-ডর। দখিনা বাতাসে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে পালতোলা ভাঙা জাহাজ যেন আরবের তাজি ঘোড়ার মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললো নতুন দ্বীপপানে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জাহাজ এসে পৌঁছলো নতুন বন্দরে।
পূর্বেই গড়ে তোলা জনপদ আর নগরীর লোকেরা বাদশাহ্র নতুন পোশাক, হাতি-ঘোড়া, বাদ্য-বাজনা নিয়ে সদলবলে বন্দরঘাটে এসে উপস্থিত হলো। কেনা গোলামকে নতুন রাজপোশাক আর রাজমুকুট পরানো হলো। ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে নতুন বাদশাহ্ রূপে রাজপ্রাসাদের দিকে নিয়ে চললো। পেছনে সারিসারি জনতা স্লোগান মুখর হয়ে উঠলো। দরবার হলে রক্ষিত ময়ূর সিংহাসনে তাঁকে সসম্মানে বসানো হলো।
মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে কাজী সাহেব এলেন, এলেন সেই বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানী লোকটি। সাথে তার অপূর্ব সুন্দরী স্বর্ণ কেশরী ষোড়শী কন্যা। দরবারের সবাই উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকলো পরবর্তী ঘটনার দিকে। আর দেরি নয়। পদ্মলোচন ষোড়শীর সাথে বিয়ে হলো নতুন বাদশাহ্র। কেনা গোলাম ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে সত্যিকারের বাদশাহ্ হলেন। সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিলেন পরবর্তী জীবন।

Share.

মন্তব্য করুন