প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মানবমনকে সবসময়ই আলোড়িত করে। প্রকৃতির এই রূপ সৌন্দর্য একেক জায়গায় একেক রকম। যদি জানতে চাওয়া হয় পানির রঙ কেমন! তাহলে সবাই বলবে যে পানির নিজস্ব কোনো রঙ নেই। তবে অবস্থাভেদে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে রঙ পরিবর্তন হতে পারে। তেমনি আজ বলবো গোলাপি হ্রদের কথা। যেখানে পানির রঙ গোলাপি।
পৃথিবীর বেশিরভাগ হ্রদই অবস্থিত উত্তর গোলার্ধে। হ্রদের জন্য বিখ্যাত হাজার হ্রদের দেশ ফিনল্যান্ড। এ ছাড়া প্রাকৃতিক হ্রদের এক বিশাল সমাহার রয়েছে কানাডা এবং সাইবেরিয়ায়। সাইবেরিয়া নামটা শুনলে আমাদের চোখে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে- বরফঢাকা বিস্তৃত একটা অঞ্চল যেখানে রোদের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না। সবসময় তুষার পড়ে, সব মিলিয়ে বরফের এক বিশাল সাম্রাজ্য। বাস্তবতা হলো রাশিয়ার এই উত্তরাঞ্চলটিতে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অন্যান্য অঞ্চলের মতোই প্রখর রোদ্দুর পড়তে দেখা যায়। তখন এই অঞ্চলের বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য পর্যটকের ভিড়ও বেড়ে যায়।
সাইবেরিয়ার একটি বিশেষ হ্রদ হচ্ছে বার্লিনস্কয়ি। এই হ্রদটিকে সাইবেরিয়ার অন্যান্য হ্রদ থেকে আলাদা করেছে এর একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য। তা হচ্ছে গ্রীষ্মকালে এই হ্রদটি গোলাপি বর্ণ ধারণ করে। হ্রদটার বৈশিষ্ট্যই আশ্চর্যজনক। বছরের অন্যান্য সময়ে হ্রদটির রঙ আর দশটা হ্রদের মতোই থাকে। হ্রদের রঙ কেমন হবে তা মূলত আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। আকাশে মেঘের আনাগোনাও হ্রদের রঙ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।

আবহাওয়া মেঘলা হলে হ্রদের রঙ হয় গাঢ় ধূসর। আর আকাশ নীল হলে হ্রদও নীল। কিন্তু গ্রীষ্মকালে হ্রদটির রঙ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয় গোলাপিতে। লেক বার্লিনস্কয়ির গোলাপি হওয়ার একমাত্র কারণ এর লবণাক্ততা নয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে এক ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিংড়ি জাতীয় জীব। এর নাম হচ্ছে  Artemiasalina. লেকের উষ্ম আবহাওয়া এবং লবণের আধিক্য এই তিনচোখো, বাইশপদী চিংড়ির বসবাসের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এরা সাধারণত আগস্ট মাসে দলবেঁধে বার্লিনস্কয়িতে আসে।
এ জন্যই মূলত লেকটি হয়ে ওঠে উজ্জ্বল ফ্লেমিঙ্গো-গোলাপি বর্ণের। সাইবেরিয়ান টাইমস অনুযায়ী, অত্যধিক গরমের কারণে লেকটি কাক্সিক্ষত সময়ের কয়েক সপ্তাহ আগেই গোলাপি বর্ণে রূপ নিয়েছে। আরেকটি বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে বার্লিনস্কয়িই পৃথিবীতে একমাত্র গোলাপি হ্রদ নয়। পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই গোলাপি হ্রদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের গোলাপি হওয়ার কারণেও আছে বৈচিত্র্য। হ্রদগুলোর গোলাপি হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে লবণপ্রেমী এক ধরনের শৈবাল। উঁহধষরবষষধংধষরহধ নামের অতিক্ষুদ্র সবুজ বর্ণের এই শৈবালগুলো ক্যারোটিনয়েডস তৈরি করে। এরা এন্টি অক্সিডেন্ট হওয়ায় পানিতে এদের উপস্থিতি ক্ষতিকর নয়। হ্রদের অতিরিক্ত লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে এই শৈবালগুলো উচ্চ পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন ধারণ করে। বিটা ক্যারোটিন রঙিন কসমেটিকস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন এ যুক্ত লাল ও কমলা শাকসবজির রঙিন হওয়ার কারণও বিটা ক্যারোটিন।
সেনেগালের উপকূলে অবস্থিত লেক রেটবা আরেকটি বিশ্ববিখ্যাত গোলাপি হ্রদ। এই লেকটিও অত্যধিক লবণাক্ত। লেক রেটবায় গেলে দেখা যায় লেক থেকে লবণ তুলতে ব্যস্ত লবণচাষিদের। আর লেকের তীরে তাদের সংগৃহীত লবণের স্তূপ। অতিরিক্ত লবণ যেন ত্বকের ক্ষতি না করে সে জন্য এই লবণচাষিদেরদের লবণ তুলতে যাওয়ার আগে শরীরে শিয়া বাটার মেখে নিতে হয়। লেক রেটবার গোলাপি হওয়ার জন্যও দায়ী Dunaliellasalina শৈবালটি। শুকনো মৌসুমে লেক রেটবার গোলাপি রঙ উজ্জ্বল হয়। আর বর্ষার মৌসুমে গোলাপি রঙ ফিকে হয়ে আসে।
লেক রেটবার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে অভিভূত করবে। লেকের তীরে লবণের পাহাড়, লেকের গোলাপি জলরাশি এবং লেকের অন্য পাড়ের সোনালি বালুকাবেলা এক অপূর্ব সৌন্দর্যের দ্যোতনা করে। নিঃসন্দেহে গোলাপি রঙা হ্রদ প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের একটি অভিনব অংশ।

Share.

মন্তব্য করুন