রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে তবুও সায়লার চোখে ঘুম নেই। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে নিজের চোখে দেখে আশা সেই নির্মম দৃশ্য! পথের পাশেই ছিন্নমূল হতদরিদ্র শিশুটি কাঁদছে আর তার সমস্ত ঘৃণা ক্ষোভ ও ভাষাহীন অবুঝ শক্তির চাহনি দিয়ে মা হারানোর বেদনা মানুষকে বুঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। উৎসুক পথচারী সবাই একটুখানি দেখে যে যার গন্তব্যের দিকে ছুটছে।
এই ছোট্ট শিশুটির আর্তনাদ যেন কেউ শুনতে পাচ্ছে না। চোখ কান হাত পা থেকেও আজ যেন তারা অন্ধ বধির অচল এক প্রাণহীন জড় পদার্থ। কিন্তু কেন? কেন আজ মানুষের হাতেই মানুষকে প্রাণ দিতে হয়? মায়ামমতা প্রেম ভালোবাসা বোধহীন এই মানুষগুলো কেন এতো হিংস্র? কোথায় আজ তাদের মানবতার বুলি? কার কাছে আজ এসব বন্ধক দিয়েছে মানুষ নামের সুন্দর আকৃতির শ্রেষ্ঠ জীবগুলো? হাজারো প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না সায়লা। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো সায়লা। এমন সময় সায়লার মা রাশিদা বেগম এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন, এতো রাতেও তুমি ঘুমাওনি সকালে কলেজে যেতে হবে, তোমাকে শরীর খারাপ করবে যে! একটা সামান্য দুর্ঘটনাকে মনের মধ্যে জিইয়ে রেখে রাত জেগে শরীর খারাপ করার মানে হয় না। ওরা ছিন্নমূল, ওদের সামাজিক স্ট্যাটাস নেই ওদের নিয়ে এভাবে ভাবতে গেলে তোমার ক্যারিয়ার বাধাগ্রস্ত হবে। মায়ের কথায় সায়লা ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- মা, ওরাও মানুষ! ওদেরও আছে আমাদের মতো রক্ত মাংস, ওদেরও সুখ দুঃখ অনুভূতি আছে। ওরা হতদরিদ্র ছিন্নমূল বলে আমাদের মতো ওদেরও এ সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার আছে। গরিব ছিন্নমূল বলে কি ওদের বাঁচার অধিকার নেই? বিচার পাবার কি অধিকার নেই ওদের? তবে কি আমাদের মানবাধিকার উঁচু-নিচু অর্থবিত্ত ধর্ম বর্ণ আর ক্ষমতার ভেদে রচিত হয়? মানবতাবোধ কি শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য? যে শিক্ষা আমাকে মানুষকে ভালোবাসতে দেয় না যে শিক্ষা আমাকে পশু ও মানুষের সমাজের পার্থক্য বুঝায় না সেই শিক্ষা আমার জন্য অহেতুক ও নিষ্প্রয়োজন মনে করি।
কারণ পশুও মানুষের মতো ক্ষুধা পেলে খায়, বাচ্চা প্রসব করে জৈবিক চাহিদা মেটায়, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয় এবং শক্তিমত্তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। আর এই মিলগুলোর মধ্যে পশুর সাথে আমি পার্থক্য খুঁজে পাই। মানুষের মতো তাদের শিক্ষার বোধ জাগে না জ্ঞানচর্চা করতে পারে না বলেই মানুষ জগতের শ্রেষ্ঠ হয়েছে। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই মানুষ মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্যসব প্রাণীর ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে। আর এই কর্তৃত্ব মানে পেশির জোরে অর্থ ক্ষমতার জোরে মানুষকে খুন করা বা উঁচু-নিচু পার্থক্য করে বৈষম্যের মাধ্যমে এই বসুন্ধরাকে উত্তপ্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা নয়! যতক্ষণ এই মানুষের মাঝে সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান না ঢুকানো যায় ততক্ষণ সে দেখতে মানুষ হলেও সত্যিকারের জীবন্ত মানুষ হয়ে ওঠে না।
রাশিদা বেগম খুব স্মার্ট ও বর্তমান সময়ের অতি আধুনিক প্রগতিশীল হলেও নিজের মেয়ের কাছে মানবতার প্রাঞ্জল শিক্ষামূলক কথা শুনে রাশিদা বেগম কিছুটা লজ্জিত ও বিব্রত হবার পাশাপাশি তার ঘুমন্ত বিবেক জেগে ওঠে। প্রচ-ভাবে নাড়া দেয় তার পাশ্চাত্যের ধার করা চিন্তাগুলো। যে চিন্তাকে এতোদিন আধুনিক শিক্ষার উপজীব্য মনে করতো সেই স্বার্থপর চিন্তার পর্দাগুলো ধীরে ধীরে সরে সুন্দর একটা বৈষম্যমুক্ত মানুষের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে লাগলো। হঠাৎ মুয়াজ্জিনের সুরেলা মধুর কণ্ঠের আজানের সুর ভেসে এলো। আর এই সুর যেন রাশিদা বেগম আজই হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে লাগলো। নতুন এক পৃথিবীর হাতছানি রাশিদা বেগমকে উদ্বেলিত করতে লাগলো। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এলো তার। অজু করে মা-মেয়ে দু’জনই সিজদায় লুটিয়ে পড়লো।

Share.

মন্তব্য করুন