‘মা, আমি স্কুলে যাচ্ছি। আজ কিন্তু আমায় পাঁচশ টাকা দিতে হবে।’
মাকে জোর গলায় বললো সায়েম। রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে মা হাসিমুখে বললেন,
– আজ আবার পাঁচশ টাকা কেন?
– আমার লাগবে। মা, তুমি না দিন দিন হিসেবি হয়ে যাচ্ছো। দাও পাঁচশ টাকা।
নয়ন বানু ছেলের কপালে চুমু খেয়ে পাঁচশ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন,
– এই নে। সাবধানে যাস, বাবা।
– ঠিক আছে, মা। আমি এখন আসি।
এই বলে বাসা থেকে বের হয় সায়েম।
সায়েম দশম শ্রেণিতে পড়ে। আর মাত্র কয়দিন পরেই স্কুলে টেস্ট পরীক্ষা। অথচ তার পড়াশুনার দিকে কোনো মনোযোগ নেই। রোজ সকালে স্কুলে যাবার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায়। কোনোদিন মনে চাইলে স্কুলে যায়। আর মনে না চাইলে যায় না। প্রথম প্রথম স্কুল থেকে ওর বাসায় ফোন করা হলেও ওর নিয়মিত অনুপস্থিতির কারণে এখন আর ফোন করা হয় না। অবশ্য এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এতে সে আরো অনিয়মিত হতে শুরু করে।
দেখতে দেখতে ওদের টেস্ট পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে।
পরীক্ষার পূর্বরাত। সায়েম পড়ার টেবিলে নেই। সায়েমের বাবা ওবায়দুল শেখ অফিস থেকে বাসায় ফিরেন। কাঁধ থেকে ব্যাগটা রেখে সায়েমের পড়ার রুমের দিকে হাঁটেন।
পড়ার রুমের বাইরে থেকে তালা ঝুলানো দেখে বললেন,
– এতো রাত হলো। সায়েম কোথায়?
– স্কুল থেকে এসে তাড়াহুডা করে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গেলো। আর তো ফিরে আসেনি।
– কি কথা বলো! আগামিকাল ওর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এখন রাত সাড়ে আটটা বাজছে। অথচ ও পড়ার টেবিলে নেই।
– আমার মনে হয় ও বন্ধুদের সাথে বাইরে কোথাও আড্ডা দিচ্ছে। তুমি একটু গিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসো না।
ওবায়দুল শেখের চোখে মুখে ব্যর্থতার ছাপ চলে আসে। তিনি স্ত্রীর দিকে করুণ দৃষ্টিতে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছুই বলতে চাইছেন। কিন্তু হতভম্ব হয়ে কিছুই বলতে পারছেন না। মাথার ওপর ফ্যান অবিরাম চলছে। প্রকৃতিতেও তেমন উষ্ণতা নেই। অথচ ওবায়দুল শেখ প্রচন্ড ঘামছেন। স্বামীকে এভাবে ঘামতে দেখে নয়ন বানু জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন,
– কি হয়েছে? হঠাৎ এভাবে ঘামছো যে!
ওবায়দুল শেখ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– ওকে নিয়ে আমাদের কতো আশা ছিলো। ও পড়াশুনা করে একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। সমাজে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। একমাত্র সন্তান বলে যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। ওর কোন সাধ অপূর্ণ রাখিনি। কিন্তু ও একবারও আমাদের কথা ভাবেনি। সমাজের পরিত্যক্তদের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছে। ওরা ওর জীবনটা শেষ করে দেবে।
এই কথা বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন সায়েমের বাবা।
নয়ন বানুও ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত। না জানি আবার কোন বিপথে চলে যায়। আজকাল কারোর জীবন ধ্বংসের জন্য কতক বন্ধুই যথেষ্ট। এইসব ভাবতে ভাবতে স্বামীকে বললেন,
– শুনুন, সায়েমের বাবা, ওসব এখন রাখুন। আগে সায়েমকে খুঁজে নিয়ে আসুন। এখন উল্টাসিধা কিছু করতে গেলেও সমস্যা। যে যুগ চলছে তাতে আরো বিগড়ে যেতে পারে।
– তুমি ঠিক বলেছো। শুধু আফসোস, আমাদের ছেলে আমাদের মতো হলো না।
এই কথা বলে ঘরের বাইরে পা রাখেন ওবায়দুল শেখ। ততোক্ষণে সায়েম বাবার সামনে মাথা নিচু করে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। ওবায়দুল শেখ নিজের রাগকে সংবরণ করে সায়েমকে নিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসেন।
পড়ার টেবিলে বসে
সায়েম মনে মনে ভাবতে লাগলো-
আগামিকাল বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষা। রাত নয়টা পনেরো মিনিটে আমি বাসায় ফিরলাম। বাবার কাছে হাতেনাতেও ধরা পড়েছি। অথচ বাবা একটু বকা দিলেন না। না, পরীক্ষার কয়দিন আর ঘর থেকে বের হবো না।
এই ভেবে বই নিয়ে পড়তে শুরু করলো। পাশের রুম থেকে ছেলের পড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুহূর্তে চিন্তিত বাবা-মায়ের মনে আশার আলো আবার জ্বলে উঠলো।
দেখতে দেখতে সায়েমের টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। কিছুদিন পর ফলাফল প্রকাশিত হলো। সায়েম চার বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এমন ফলাফলে ওবায়দুল শেখ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। স্কুল কর্তৃপক্ষও এবার খুব কড়াকড়ি করছেন। কোনোমতে অকৃতকার্যদের ফরম ফিলাপ করাবেন না। তিনি ভাবতে লাগলেন,
এ মুহূর্তে কী করা যায়। ও যে রেজাল্ট করেছে তাতে কারো কাছে সুপারিশও চাওয়ার সুযোগ নেই। তার ওপর ফরম ফিলাপের সময়ও শেষের দিকে। ওবায়দুল শেখ ভেবে কোনো কূল পাচ্ছেন না।
পরদিন তিনি ছেলেকে সাথে নিয়ে স্কুলে আসেন। প্রিন্সিপালের রুমের সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। অবশেষে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ আসে তাদের। প্রিন্সিপালকে সালাম দিয়ে ইতস্তত দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর প্রিন্সিপাল ওবায়দুল শেখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আপনি কি জন্য এসেছেন?
– স্যার, আমি সায়েমের বাবা। আমি এসেছি সায়েমের রেজাল্টের বিষয়ে কথা বলতে।
সায়েমের দিকে একটু তাকিয়ে তিনি বললেন,
– তোমার রোল নম্বর কত?
– ৫৯৪, স্যার।
প্রিন্সিপাল স্যার রেজাল্ট শিটটা একনজরে দেখে নিয়ে বললেন,
– ওকে নিয়ে আবার কেন এসেছেন? ও তো চার বিষয়ে ফেল করেছে। এ বছর ও পরীক্ষা দিতে পারবে না।
পাশ থেকে সায়েমের বাবা নরম গলায় বললেন,
– স্যার, পরীক্ষা দেবার সুযোগ যদি দিতেন।
প্রিন্সিপাল রাগত স্বরে বললেন,
– না, ও এ বছর কোনোমতে পরীক্ষা দিতে পারবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারে না। ওর মতো শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা দিতে দিলে আমার প্রতিষ্ঠানের সার্বিক ফলাফলে বিপর্যয় নেমে আসবে। আপনি ওকে নিয়ে চলে যান।
– স্যার, একবার অনুমতি দিন। আমি এরপর থেকে ওর পিছে আঠার মতো লেগে থাকবো। আপনারা প্রতিষ্ঠান থেকে যা যা করতে বলবেন আমি তা মেনে নেবো। প্রয়োজনে অঙ্গীকারনামা জমা দেবো। তবু ওকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দিন, স্যার।
সায়েম বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথানিচু করে থাকে। মনে মনে ভাবে,
হায়! শুধু আমার একটু অবহেলার জন্য আজ আমার বাবাকে এমন অসম্মানে পড়তে হচ্ছে।
প্রিন্সিপাল স্যার উত্তেজিত হয়ে বললেন,
– না, এ বছর ওকে আমরা পরীক্ষা দিতে দেবো না। আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যান। আগামি বছর টেস্টে পাস করতে পারলে পরীক্ষা দিতে পারবে।
– স্যার, একটু দয়া করুন।
প্রিন্সিপাল স্যার রাগান্বিত হয়ে বললেন,
– না, ও এ বছর পরীক্ষা দিবে না। আর আপনি দাঁড়িয়ে থেকে শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করছেন। আপনি বেরিয়ে যান। নইলে আমি পিয়ন ডাকতে বাধ্য হবো।
প্রিন্সিপালের এমন আচরণে মাথা নিচু করে রুম থেকে বের হন ওবায়দুল শেখ। সায়েমও বাবার পিছুপিছু বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। পুরো পথে কেউ কারো সাথে কোন কথা বলেনি।
এভাবে কয়েকদিন কেটে গেলো। সায়েমকে দেখলে বাবা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইদানীং বাবা-মায়ের মন খারাপ করে থাকা ওর একদম ভালো লাগে না। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই সায়েমের নিজের ওপর রাগ বাড়ছে। ধীরে ধীরে ও নিজের ভুল বুঝতে পারছে। বেপরোয়া চলাফেরা আর নিয়মিত পড়াশুনা না করাই তার জন্য কাল হয়েছে। যে বন্ধুদের নিয়ে সে মজেছিল তারাও এখন তার কাছাকাছি ভিড়ে না। সায়েমও বাবা-মার কাছে আর আগের মতো টাকা পয়সা চায় না। বুকের মধ্যে পাহাড়সম তিরস্কার আর সীমাহীন কষ্টের লেলিহান শিখা নিয়ে তার একাকি পথচলা।
গভীর রাত। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সায়েমের চোখে ঘুম নেই। ওর কাছে চিরচেনা পৃথিবীটা বড় অচেনা বলে মনে হচ্ছে। ও চোখ বন্ধ করে জোরেজোরে শ্বাস নিতে থাকে। খুব টেনশনে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
সায়েমের কান্নার আওয়াজ শুনে ওর বাবা-মার ঘুম ভেঙে যায়। দু’জনে ওর রুমের দিকে দৌড়ে আসেন। নয়ন বানু ছেলেকে ছোট্ট শিশুর মতো বুকের মধ্যে নিয়ে কাঁদতে থাকেন। ওবায়দুল শেখ সায়েমের কাছাকাছি খাটের ওপর বসে মায়ার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। দু’চোখে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। সায়েম বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে লাগলো। ওবায়দুল শেখ ছেলের কান্না থামিয়ে বললেন,
– কী হয়েছে তোমার! এভাবে কাঁদছো কেন? কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছো কি?
সায়েম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো,
– বাবা! মা! আমি তোমাদের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। নিয়মিত পড়াশুনা করিনি। তোমাদের সম্মানের কথা না ভেবে খারাপ-বখাটেদের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছি। ওদের খপ্পরে পড়ে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। পরিণামে টেস্টে ফেল করে তোমাদের সব আশা-ভরসাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি। এতো অপমানের পরও বাবা আমাকে কোন মারধর করেননি। শুধু ঘৃণায় আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমার বন্ধুরাও এখন আর আমার কাছে আসে না। কেউ কেউ বলে আমি নাকি একেবারে শেষ হয়ে গেছি।
কিন্তু আমি একেবারে শেষ হয়ে যাইনি। আমি থেমে গেছি ঠিকই। আবার চলতে শুরু করবো। আর গন্তব্য না পৌঁছা পর্যন্ত থামবো না। আর এই স্কুলে আমাকে আবার নবম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দাও। আমি দিনরাত পড়াশুনা করবো। আমার জন্য প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে তোমাকে যেভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে তার প্রতিটি কথা আমাকে প্রতি মুহূর্তে ভাবিয়ে তুলছে। আমি আবার ভালো হতে চাই, বাবা।
ওবায়দুল শেখ ছেলের অনুভূতি জেনে মনে মনে খুশি হন। তারপর সায়েমকে জিজ্ঞেস করেন,
– ঠিক আছে, বাবা। আগামিকালই তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবো। নবম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেবো। এ নিয়ে আর কোন চিন্তা না করে এখন ঘুমাও।
– জি বাবা! বলে আবার শুয়ে পড়ে সায়েম।
ওবায়দুল শেখ স্ত্রীকে সাথে নিয়ে মনের সুখে নিজেদের রুমের দিকে চলে আসেন।
পরদিন সায়েমকে আবার নবম শ্রেণিতে ভর্তি করতে স্কুলে আসেন সায়েমের বাবা। প্রথমে প্রিন্সিপাল স্যারকে বিষয়টা খুলে বললেন। তিনি খুব খুশি হয়ে সায়েমকে সাহস জোগান। এরপর ওকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করেন। শুরু হলো সায়েমের ভালো হওয়ার মিশন। দিনরাত বই নিয়ে পড়ে আছে ও। কোনো খারাপ বন্ধুর সাথে মিশে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করে। বড়োদের সাথে দেখা হলে মোলায়েম কণ্ঠে সালাম দেয়। ছোটোদের সাথেও সুন্দর আচরণ করে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজের শেষে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করে। সায়েমের এমন পরিবর্তনে ওর বাবা-মা’র মন খুশিতে ভরে যায়। আবার সব কিছু সুন্দরভাবে চলতে শুরু করে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সায়েমেরও পরিবর্তন হয়। জীবন চলার পথে সায়েম হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ মুহূর্তে হয়তো তার কিছুটা সময় খুব আমোদে কাটছে না। তবু স্বপ্নের সোনার হরিণের পিছে সে দুর্বার ছুটছে।

Share.

মন্তব্য করুন