বিশ্ব ফুটবল নতুন এক তারকার আবির্ভাব দেখেছে ২০১৭ সালে। তিনি আর কেউ নন, মিসরের স্ট্রাইকার মোহাম্মদ সালাহ। জাতীয় দলের পাশাপাশি ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ আসরগুলোতেও যিনি আলো ছড়াচ্ছেন কয়েক মৌসুম ধরে। বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র ইউরোপ। ঘরোয়া বা ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে অভিজাত অঙ্গন এটি। ক্রিকেটারদের মতো ফুটবলারদের জাতীয় দলের হয়ে সারা বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে হয় না। তাই বছরের বেশির ভাগ সময় তারা কাটান ক্লাব ফুটবলে। তুমুল প্রতিযোগিতা, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর সেরা মানের জন্যই বিশ্বের সেরা ফুটবলাররা ভিড় করেন ইউরোপের ক্লাবগুলোতে।
তারকায় ভরপুর ইউরোপের ফুটবল আসরগুলোতে অন্যদের সাথে সমান তালেই লড়াই করে চলছেন মোহাম্মদ সালাহ। বর্তমানে খেলছেন ইংল্যান্ডে ক্লাব লিভারপুলে। ২০১৭ সালে অর্জন করেছেন আফ্রিকা মহাদেশের সেরা ফুটবলারের খেতাব, হয়েছেন বিবিসির মনোনীত সেরা আফ্রিকান ফুটবলার। চলতি মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তার দলকে রেখেছেন পয়েন্ট তালিকার প্রথম দিকে। লিগের গত নভেম্বর মাসের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। এ বছর ইংল্যান্ডের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি তার হাতেই উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত বছর জায়গা করে নিয়েছেন আফ্রিকা মহাদেশ ও আফ্রিকান ন্যাশন্স কাপের সেরা একাদশে। সবচেয়ে বড় কথা তার কৃতিত্বেই ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছে মিসর।
রাজনৈতিক গোলযোগ আর সামরিক শাসকদের নির্যাতন-নিপীড়নে হাসতে ভুলে যাওয়া মিসরের মানুষকে সালাহ অনেক বছর পর এনে দিয়েছেন কিছুটা হলেও আনন্দের মুহূর্ত। চরম অস্থিরতার মাঝেও দেশটির ফুটবল সমর্থকরা এবার পেতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপের স্বাদ। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে মিসর ও সমগ্র আফ্রিকা অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫টি গোল করেছেন সালাহ। শেষ ম্যাচে কঙ্গোর বিরুদ্ধে জোড়া গোল করে তাক লাগিয়ে দেন ফুটবল বিশ্বকে। তার হাত ধরেই গত বছর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল আসর আফ্রিকান কাপ অব ন্যাশন্সের ফাইনালে ওঠে মিসর। ইউরোপের ফুটবলেও সেই দাপট অব্যাহত রেখেছেন মোহাম্মদ সালাহ। ক্ষিপ্রগতি আর দারুণ সব কৌশলের কারণেই ইউরোপের গতিময় ফুটবলের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলছেন। তার ড্রিবলিং, বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিংবা গোল করার দারুণ দক্ষতাই তাকে তারকা বানিয়েছে। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বল নিয়ে ছুটে যান গোলপোস্টের দিকে। দুই পায়েই দারুণ গোল করতে পারেন। ২৫ বছর বয়সী সালাহকে অনেকেই বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যৎ মহাতারকা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন।
লিভারপুলের হয়ে ইংলিশ ফুটবলের ২০১৭-১৮ মৌসুমের প্রথম ২৮ ম্যাচেই ২৪ গোল করেছেন (মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত)। আর সে পর্যন্ত ইউরোপীয় ফুটবলের সব ম্যাচ মিলে ৩২ গোল করেছেন। ২০১১-১২ মৌসুমের পর লিভারপুল আর কোন শিরোপা জিততে পারেনি। শিরোপা খরায় ভুগতে থাকা দলটিকে এবার তাই নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মোহাম্মদ সালাহ। তার দারুণ ফুটবল নৈপুণ্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন লিভারপুলের ভক্তরাও। তারা ভালোবেসে সালাহকে উপাধি দিয়েছন ‘ইজিপশিয়ান কিং’ বা মিসরীয় স¤্রাট। ক্লাব সমর্থকরা সালাহর প্রতি এতটাই মুগ্ধ যে, খেলার সময় গ্যালারিতে তারা একযোগে গলা মিলিয়ে মিসরীয় আরবি গানের কোরাস গাইতে থাকেন। মাঠে সমর্থকদের কণ্ঠে শোনা যায়, ‘মো সালা-লা-লা-লা-লাহ, মো সালা-লা-লা-লা-লাহ। যদি সে তোমার জন্য ভালো হয় তবে সে আমার জন্যও ভালো। যদি যে আমাদের হয়ে আরো কিছু গোল করে তবে আমরা মুসলিম হতেও রাজি। যদি সে মসজিদে যায় তবে আমিও রাজি সেখানে যেতে।’
এটি আসলে মিসরের একটি পুরনো গান; কিন্তু লিভারপুল ভক্তরা গানটির সাথে তাদের প্রিয় ফুটবলারের নাম জুড়ে দিয়ে মাঠে উৎসাহ দিতে চেষ্টা করেন। ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতেও দেখা গেছে লিভারপুল সমর্থকরা এই গানের সাথে গলা মেলাচ্ছে।
লিভারপুলে আসার আগে ইতালির এএস রোমা, ফ্লোরেন্তিনা ও ইংল্যান্ডের চেলসি ক্লাবে খেলেছেন মোহাম্মদ সালাহ। পেশাদার ফুটবলে তার অভিষেক ২০১০ সালে মিসরের আল মোকাওলুন ক্লাবের হয়ে। ২০১২ সালের মার্চে মিসর অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে সুইজারল্যান্ডে প্রীতি ম্যাচ খেলতে গেলে তাকে পছন্দ করেন সুইস ক্লাব বাসেলের কর্মকর্তারা। একবারেই চার বছরের জন্য চুক্তি করে তার সাথে ক্লাবটি। এখানেই শুরু হয় সালাহর ক্যারিয়ারের সোনালি যুগের। সে বছরই ক্লাবটিকে সুইস লিগে চ্যাম্পিয়ন করেন সালাহ। দুই মৌসুম খেলার পর লন্ডনের বিখ্যাত ক্লাব চেলসি তাকে নেয় এক কোটি ১০ লাখ পাউন্ড ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে। ২০১৪-১৫ মৌসুমে চেলসির হয়ে জিতেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগসহ দু’টি শিরোপা। ২০১৫ সালের শুরুতে চেলসি থেকে ধারে খেলতে নেয় ফ্লোরেন্তিনা। দলটি তাকে স্থায়ীভাবে রাখতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। এরপর ইতালিরই আরেক ক্লাব রোমায় ধারে খেলতে গিয়ে ক্লাবটির সাথে স্থায়ী চুক্তি করেন সালাহ। সেখানে দুই মৌসুম খেলেই ২০১৭ সালের জুনে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলে যোগ দেন ৫ কোটি ইউরোর বিনিময়ে। সেই থেকেই ক্লাবটিকে একের পর এক ম্যাচে সফলতা এনে দিচ্ছেন ‘মিসরীয় সম্্রাট’।
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধার্মিক মোহাম্মদ সালাহ। প্রায়ই দেখা যায় গোল করার পর মাঠেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। লিভারপুলের সমর্থকরাও তার ধার্মিক মানসিকতার বিষয়ে উৎফুল্ল। বিবিসি তাদের এক রিপোর্টে লিখেছে, ‘তার ধর্মীয় মূল্যবোধ অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, বিশেষত লিভারপুলের সমর্থকদের জন্য।’ ২০১৩ সালে জুলাইতে সুইজারল্যান্ডের বাসিল ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে ইসরাইলি ক্লাব মাকাবির খেলোয়াড়দের সাথে হ্যান্ডশেক করতে অস্বীকৃতি জানান সালাহ। আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিয়মানুয়ায়ী ম্যাচ শুরুর আগে দুই দলের খেলোয়াড়দের হ্যান্ডশেক করার আইন সালাহ ভেঙেছিলেন ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে।
এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ইউরোপের ফুটবলে এই মুহূর্তে বেশ কয়েকজন মুসলিম ফুটবলার দাপটের সাথে বিচরণ করছেন। তাদের মধ্যে আর্সেনালে খেলা জার্মানির মেসুত ওজিল, বার্সেলোনায় খেলা ফ্রান্সের ওসমান ডেম্বেলে ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলা পল পগবা এবং লিস্টার সিটিতে খেলা আলজেরিয়ার রিয়াদ মাহরেজ অন্যতম।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সালাহর পদচারণা শুরু হয় মিসরের অনূর্ধ্ব-২০ দল দিয়ে। ২০১১ সালের অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপেও খেলেছেন দেশের হয়ে। সে বছরই জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। এরপর অবশ্য অনূর্ধ্ব-২৩ দলেও খেলেছেন। জাতীয় দলের হয়ে ৫৬ ম্যাচে ৩২ গোল করেছেন এই মিসরীয়। আছে একটি হ্যাটট্রিক। আর ক্লাব ফুটবলে গত মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ২৮৯ ম্যাচে গোল ১০৯টি। কিছুদিন পরেই রাশিয়ায় শুরু হবে বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপে মিসরবাসী ভালো কিছু পাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই তাকিয়ে থাকবেন তাদের সবচেয়ে বড় এই তারকার দিকে। সালাহও নিশ্চয়ই চাইবেন নিজের প্রথম বিশ্বকাপটিকে ভালো কিছুর মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখতে।
২০১৩ সালে ম্যাজি নামে মিসরীয় এক তরুণীকে বিয়ে করেন সালাহ। তাদের সংসারে রয়েছে মক্কা নামে এক কন্যা। বর্তমানে সালাহর বয়স ২৫ বছর। ইনজুরি মুক্ত থাকতে পারলে আরো অন্তত ৮-১০ বছর পেশাদার ফুটবলে খেলা সম্ভব। বর্তমান ফর্ম আর ফিটনেস ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে মোহাম্মদ সালাহকে দেখা যেতে পারে বিশ্বসেরা ফুটবলারদের কাতারে।

Share.

মন্তব্য করুন