পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। বাঙালি জাতির পালনীয় ও ঐতিহ্যবাহী একটি সংস্কৃতি। বাঙালি জাতি হিসেবে বাংলা নববর্ষের দিনটিকে আমরা নানা আয়োজনে বরণ করে নেই। ৩৬৪ দিন আর যেই সংস্কৃতি ধারণ করি না কেন! একটি দিনের জন্য আমরা খাঁটি বাঙালি হয়ে যাই। সকালে এসে ইলিশ ভাজা আর পান্তা ভাত খাওয়া, হলুদ শাড়ি পরে রমনার বটমূলে গলা ফাটিয়ে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গান গাওয়া, যুবক-যুবতী হাতে হাত ধরে ‘বৈশাখী নৃত্য’ হাজারও দর্শকের সামনে পরিবেশন করা, আরও কতো কি! এই হলো আমাদের বর্তমান সমাজে প্রচলিত পহেলা বৈশাখ সংস্কৃতি। কিন্তু এগুলোই কি আমাদের (বাঙালিদের) পহেলা বৈশাখের শিকড়ের সংস্কৃতি? না ভিন্ন কিছু?
পহেলা বৈশাখ এলো যেভাবে
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। এতে অসময় কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি গ্রেগরীয় সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ৯৬৩ হিজরি (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরি সালের মুহাররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেকে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হতো। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিলো একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। পহেলা বৈশাখে এসব নিয়ম-কানুন এখনো আছে।

Share.

মন্তব্য করুন