আমরা সবাই আকাশে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি উড়তে দেখেছি। গ্রীষ্মকাল আসতে না আসতেই আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় উড়ন্ত ঘুড়ি। ছোটো বড়ো মিলে আকাশের নানা জায়গায় উড়ছে রঙিন ঘুড়ি। এই ঘুড়ি নিয়ে অনেক স্থানে উৎসবও করা হয়। গ্রীষ্মকালীন ব্যতীত অন্য সময় আকাশে তেমনটা দেখা মিলে না ঘুড়ির। ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে আবার অনেকে পাল্লা দেয়। বড়োদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখে ছোটোরাও আনন্দ পায়। উড়ন্ত ঘুড়ি সকলের মনে নিয়ে আসে আনন্দের ছবি। কেউ ঘুড়ি উড়ায় আবার কেউ ঘুড়ি লুট করে। এমন দৃশ্য এখন গ্রাম ও শহর এলাকায় দেখা মেলে।
ঘুড়ি হলো একধরনের হালকা খেলনা। যা সুতা টেনে আকাশে ওড়ানো হয়। সাধারণত কাগজ, সিল্কের কাপড় ও অন্য কোনো পাতলা জিনিস দিয়ে তৈরি সমদ্বিবাহু আকৃতির আকাশে উড়ানোর একটি খেলনা। এটি অর্ধবৃত্তাকার কাঠামোর ওপর তৈরি করা হয় এবং উড়ার সময় যাতে ভারসাম্য থাকে সে জন্য এতে একটি লেজ জুড়ে দেয়া হয়।
ঘুড়ি অনেক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- ভুয়াদর ঘুড়ি, ছাতা ঘুড়ি, কচ্ছপ ঘুড়ি, লাটিম ঘুড়ি, প্রজাপতি ঘুড়ি, তারা ঘুড়ি। সাধারণত ঘুড়ি দুই প্রকারের সুতাওয়ালা ঘুড়ি এবং সুতাবিহীন ঘুড়ি। সুতাওয়ালা ঘুড়ির মধ্যে আছে গুড্ডি, ঢাউশ, চং, চোঙা আর সুতাবিহীন ঘুড়ির মধ্যে আছে ফানুস, বেলুন, হাউই, উড়োজাহাজ, রকেট ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রকারের ঘুড়ির মধ্যে গুড্ডিই বেশি জনপ্রিয়। সাধারণত এ ঘুড়ি বর্গাকার আকৃতিতে বানানো হয় এবং কিছু কিছু রম্বসাকৃতি ও চতুর্ভুজাকৃতির হয়ে থাকে।
ঘুড়ি, আবহমানকাল থেকে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। একসময় ছেলে বুড়ো সবার কাছে ঘুড়ি উড়ানোর জনপ্রিয়তা ছিলো তুমুল। পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘুড়ি উড়ানো হয়। এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার এবং ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু দেশেও ঘুড়ি উড়ানো হয়, যা শৈল্পিক ও বর্ণাঢ্য নকশার নিদর্শন।
আজকাল যতো রকমের ঘুড়ি দেখা যাচ্ছে সেগুলো কখন, কোথায় এবং কে প্রথম বানিয়েছিলো তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। জানা গেছে, ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বে গ্রিস দেশে বিশ্বের প্রথম ঘুড়ি তৈরি হয়েছিল। ঘুড়িটি উড়িয়েছিলেন বিজ্ঞানী আরকিয়াটাস। আবার অনেকের ধারণা, ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব চীন দেশে প্রথম ঘুড়ি তৈরি হয়েছিলো। সেই ঘুড়িটি তৈরি করেছিলেন সেনাপতি হানসিন।
চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং কোরিয়া হলো বর্ণময় ঘুড়ির পীঠস্থান। শুধু চীনেই আছে ৩০০ রকমের ঘুড়ি। প্রজাপতি, মাছ, পাখি, মৌচাক, ড্রাগন, চিল, মানুষসহ আরো কতো রকমের ঘুড়ি যে আছে তার ইয়ত্তা নেই। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের দিকে চীন দেশের মানুষ প্রথম কাগজ আবিষ্কার করে। এ থেকে অনেকেই মনে করেন যে, ঘুড়িও সম্ভবত চীন দেশেই প্রথম তৈরি হয়েছে। কিন্তু চীনা ঘুড়িনির্মাতাদের দাবি- ঘুড়ি এ দেশেই প্রথম তৈরি হয়েছে এবং পরে তা অন্যান্য দেশে চলে গেছে। যাদের ধারণা, ঘুড়ি চীনেই প্রথম তৈরি হয়েছে তাদের মতে, চীন থেকে জাপান এবং পরে অন্য অনেক দেশ ঘুরে তা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু সুতোর কাপড়ের বা সিল্কের কাপড়ের ঘুড়ি অবশ্যই ভাবিয়ে তোলে যে, কাগজ আবিষ্কারের অন্তত কয়েক হাজার বছর আগেই ঘুড়ির জন্ম হয়েছে। নৌকার পাল, নিশান ও গেড়ে দেয়া কাপড় বাতাসে উড়তে দেখেই তো কাপড়ের ঘুড়ি জন্ম নিলো।
ঘুড়ি নিয়ে বিশ্বে রেকর্ড হয়েছে অনেক। ১৯৬৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রফেসর ফিলিপ আর কুনজ এবং জেপি কুনজ উয়োমিংয়ের লারামি থেকে ২৮ হাজার ফুট উঁচুতে ঘুড়ি উড়িয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন এবং ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত একটানা সাত দিন অর্থাৎ ১৬৯ ঘণ্টা ঘুড়ি উড়িয়ে রেকর্ড করেছিলো ফ্লোরিডা শহরের ল্যান্ডার ভিলে ‘দ্য সানরাইজ ক্লাব’। ১৯৩৬ সালে জাপানের নারুতা শহরে তৈরি হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ঘুড়ি। ওই ঘুড়ির ওজন ছিলো প্রায় সাড়ে ৯ টন। তিন হাজার ১০০ টুকরো কাগজ দিয়ে ঘুড়িটি তৈরি হয়েছিলো।
বাংলাদেশে এখন এ মওসুমে ঘুড়ি উড়ানোর ধুম পড়ে গেছে। গ্রামাঞ্চল ও শহরের নীল আকাশে এখন শুধু ঘুড়ি উড়ছে। ডানপিটে ছেলেরা ‘বাকাট্টা’ বলে উল্লাস করছে। কেউ কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে আবার কেউ ঘুড়ি উড়ায় আবার কেউবা ঘুড়ি লুট করে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকায় ঘুড়ি খেলার (ঘুড়ি লুট) প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আগে গ্রামাঞ্চলে ঢাকঢোল পিটিয়ে আনন্দঘন উৎসবে ঘুড়ি খেলার প্রতিযোগিতা হতো। কেউ ছিল লাল দলে, কেউবা কালো কিংবা নীল দলে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো দু’দলের মধ্যে। এখন ওই আগের মতো আর গ্রামগঞ্জে ঘুড়ির প্রতিযোগিতা চোখে পড়ে না। গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে ঘুড়ি প্রতিযোগিতা (লুট)। তবে ডানপিটে ছেলেদের ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়। আমাদের দেশে ঘুড়ি প্রতিযোগিতা অন্যান্য দেশের মতো অতটা জমজমাট নয়। এ মওসুমের শেষ দিনে আকাশজুড়ে ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়। আবার পুরান ঢাকায় এখন ঘুড়ি উৎসব পালন করেন পুরনো ঢাকাবাসী। এ ছাড়া শহরের অন্যান্য এলাকাতে ছোটো ছোটো ছেলেরা ঘুড়ি উড়িয়ে থাকে। প্রতিটি বাড়ির ছাদে দেখা যায় ডানপিটে ছেলে নাটাই হাতে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। এ রকম দৃশ্য গ্রামেও কমবেশি দেখা মেলে।
পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উৎসব পালন হয় সবচেয়ে বেশি। ঘুড়ি উৎসবের দিনে সুতোর মাঞ্জা দিয়ে রঙবেরঙের নানা বৈচিত্র্যের ঘুড়ি নিয়ে আকাশে ঘুড়ির লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। তবে আজ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঘুড়ি উড়ানোর মনোরম এই ঐতিহ্য। নাটাই হাতে ঘুড়িকে বধ করে রাখার মধ্যেই ঘুড়ি খেলা সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের দেশে শুরু হয়েছে বিভিন্ন ধরনের কাইট স্পোর্টস। এর মধ্যে রয়েছে স্নো কাইটিং, প্যারাসেইলিং, কাইট সার্ফিং, কাইটল্যান্ড বোর্ডিং, কাইট বাগিং, পাওয়ার কাইটিং, কাইট সেইলিং ইত্যাদি।
বরফে ঢাকা দেশে স্নো কাইটিং করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত ঘুড়িগুলো এতো বড়ো যে বরফের মধ্যে সার্ফিং কিংবা লাফ দেয়ার পুরো শক্তি ঐ কাইট থেকে পাওয়া যায়। স্নো কাইটিং কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে; ওয়েট, কাইট সাইজ, স্নো কন্ডিশন, উইন্ড স্পিড। রাশিয়া, কানাডা, আইসল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, আস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, আমেরিকার কিছু অঞ্চলে স্নো কাইটিং বেশ জনপ্রিয়।
প্যারাস্যুটে করে শূন্যে ওঠাই হচ্ছে প্যারাসেইলিং। এক্ষত্রে বোট কিংবা গাড়িতে দড়ির সাহায্যে আটকিয়ে প্যারাসুটকে ওড়ানো হয়। আর প্যারাসুটে থাকা ব্যক্তিও এর সাথে আকাশে উড়ে। আমাদের দেশে ঘুড়ি উৎসব প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। এই উৎসব যেমন আমাদের আনন্দ দেয় তেমনি আমাদের সংস্কৃতিকেও বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। তাই আমাদের উচিত আমাদের এই সমৃদ্ধপূর্ণ ঐতিহ্যকে রক্ষা করা।

Share.

মন্তব্য করুন