আজকের ৬ ফেব্রুয়ারি দিনটার কথা কী বলবো। স্কুলজীবনে এটি ছিলো আমার খুব খুব মজার দিন। স্কুল থেকে জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য প্রত্যেক ক্লাস থেকে ১২ জন করে সিলেক্ট করেছে। আমাদের ৯ম শ্রেণি থেকেও ঠিক ১২ জন সিলেক্ট করেছে। আমাদের ৯ম শ্রেণির টিমে মেয়ে ছিল ৮ জন আর ছেলে ৪ জন। মেয়েদের মধ্যে ক্লাসের অন্যতম শিল্পিরা হলো ঐশি, আরিফা, তিশা, নিশাত, হুমাইরা, মুক্তা, সানজিদা ও তানিয়া। ছেলেদের মধ্যে অন্যতম শিল্পিরা হলো ফোরকান, ইমতিয়াজ, জাহেদ সাথে এই অধমকেও রেখেছে।
আমাদের প্রিয় দিদার স্যার গতকাল বললেন, আগামিকাল সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে উপস্থিত থাকার জন্য। স্যারকে সবাই যেমন ভালোবাসে বা মজার চোখে দেখে ঠিক তেমন ভয়ও করে। আমার যা মনে হলো, সবাই রাত থেকেই রেডি হতে শুরু করেছে। যাক বাবা, সবাই সময়মতো হাজির। কিছুক্ষণ সংগীত রিহার্সেল দেয়ার পর স্যার বললেন, কয়েকজনকে অফিসে যাওয়ার জন্য। টিমের মধ্যে কয়েকজন অফিসে গেলো। ঐশি আর সম্ভবত মুক্তা। অফিস থেকে বের হতে দেখি তাদের মুখের অবস্থা ভালো না। নিশ্চয় কোনো খারাপ সংবাদ তা আমার বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু খারাপ বার্তাটা কী এখনো জানতে পারলাম না। আমাদের সামনে এসে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। জিজ্ঞেস করতে না করতেই ঐশি বলছে, তিশা আর হুমাইরা ছাড়া আর সবাইকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলেছে। আমরা টিমের অন্য সবাই পুরো অবাক! কি বলছো এটা? এটা কখনো হতে পারে!
কথাটা শুনে তিশা আবেগে কেঁদে ফেলেছে আর হুমাইরা মন খারাপ করে বসে আছে। সান্ত¡না দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। কতো আশা নিয়ে এসেছিলো সবাই একসাথে মজা করে প্রতিযোগিতায় যাবে। সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। ইচ্ছে করছে আমিও না যাই।
আবার ভাবলাম এতো ভেঙে পড়লে চলবে না। ঐশি আর আমি স্যারের কাছে গেলাম। স্যারকে তাদের দু’জনের কথা বললাম। কিন্তু স্যার আমার কথা পাত্তাই দিলো না। হুমাইরার মন খারাপ আর তিশার চোখের পানি দেখে সত্যিই আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ইচ্ছে করছে তাদের জন্য কিছু করি। কিন্তু আমার চেষ্টা আর ছোট্ট মস্তিষ্ক দিয়ে তাদের জন্য কিছু করতে পারলাম না। চোখে জল একটুখানি আমারো এসেছিল, কিন্তু কাউকে দেখতে দিইনি। ছেলে আর মেয়ে বন্ধু দু’জনের বেলায়ই আমার সেইম অবস্থা বা পরিস্থিতি তৈরি হতো। সুতরাং বিষয়টাকে অন্যদিকে ঘুরানোর কোনো সুযোগ নেই। বুকভরা কষ্ট নিয়ে সবাইকে বললাম- চলো চলো, সবাই চলো। গাড়িতে যখন বসলাম ইউনিয়ন পরিষদে যেতে তখন তাদের মুখের চাউনি দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই আমরা বন্ধু হিসেবে ভুল করছি। তাদের এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া আমাদের উচিত হচ্ছে না। স্যার বলছে- ড্রাইভার সাব, গাড়ি টান দেন। তখন যেন আমার মনেও টান দিয়ে উঠেছিলো। আর কিছুই করার রইলো না আমাদের।
তাদের চোখের পানিগুলো আমাকে যেন ভাবাচ্ছে। কী যেন বলছে আমাকে! গাড়িতে সবাই কথা বলছে। কিছুক্ষণের জন্য আমি নীরব ছিলাম। তারপর আবার ভাবলাম এভাবে গোমড়া মুখে বসে থাকলে অন্যরা কী ভাববে?
তাই ভাবলাম, এভাবে গোমড়া মুখ করে না রেখে তাদের উৎসাহ দিয়। কিন্তু উৎসাহ দিতে গিয়ে ঠিক তার উল্টো করে ফেলেছি। কি করতে যে কি করি!
কিছু সময় গাড়িতে থাকার পর আমরা গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছি। কিন্তু ভালো লাগছে না। দু’জন বন্ধুকে হারাতে হলো কিছু সময়ের জন্য। বোধহয় সবাই তাদের দু’জনের জন্যই আমার মতো মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে পুরোপুরি বলতে পারবো না সবার মনে কী চলছে। আমিতো আর মনোবিজ্ঞানী নই যে, সবার মনের কথা বলতে পারবো। অন্য কারো মনে অন্য ভাবনাও থাকতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদের ভেতর আমি কম্পিউটার কোচিং করতাম। যেহেতু সবাই দাঁড়িয়ে আছে তাই আমি কম্পিউটার ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। কম্পিউটারের প্রত্যেকটা বাটন টিপতে তাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এ কেমন মায়ায় জড়িয়ে গেলাম বুঝতে পারছি না। কম্পিউটার রুমেও ভালো লাগছে না, নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কয়েক মিনিট পরে দেখি, ক্লাসমেটরা মানে টিমের সবাই হই-হুল্লোড় করছে। কোচিং রুমের জানালা দিয়ে একটু তাকাতে দেখি তিশা আর হুমাইরাকে। খুশিতে ইচ্ছে করেছিলো ছেলে বন্ধুদের মতো জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নীরব থাকতে। কিন্তু পারলাম না। কারণ তারা তো আর ছেলে বন্ধু নয়। বিষয়টা আবার কেউ অন্যভাবে ভাববে না। সত্যিকারের মনের আবেগটা লিখলাম। বাইরে একটু দাঁড়ানোর পর কোচিং রুমে তিশা, হুমাইরা আর আরিফা এলো। তাদের বসতে বললাম। কিছু বলতে না পেরে তাদের দু’জনকে একটা থ্যাংকস্ দিতে ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু তাও দিলাম না। অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়ার পর স্যার সবাইকে ইউনিয়ন পরিষদের ভিতর ঢুকতে বললেন। ভিতরে গেলাম। সভাপতি আর বিচারকরা বক্তব্য দিলেন। কিভাবে গাইতে হবে, কিভাবে দাঁড়াতে হবে বিভিন্ন টপিক নিয়ে কথা বলছেন। আবার আমরা বাইরে চলে এলাম।
প্রতিযোগিতা শুরু। প্রথমে প্রাইমারি লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিযোগিতা চলছে। একটু ওয়েট করতেই তাদের শেষ। এবার আমাদের পালা। প্রথম প্রতিযোগী হিসেবে পাবলিক স্কুল গেলো। তারা আমাদের লেভেলের তো, তাই তাদের একটু গলার সুর শুনতে টিমের সবাই ব্যাকুল হয়ে ছুটাছুটি করছে। তারপর গেলো ভুজপুর ন্যাশনাল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছি। সবাই পরামর্শ করছি, আমরা কেমন করবো, দাঁড়ানোর স্টাইল কেমন হবে ইত্যাদি করতে করতে আমাদের পালা চলে এলো। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ফোরকান এক-দুই-তিন বলার সাথে সাথে জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয়ে গেলো। সবাই ঠিকঠাক ভাবে গাইলো। কিন্তু আমি অধম একটু বেশি নড়াচড়া করে ফেলেছি। সঙ্গীত শেষ হতেই বিচারক বললো, শেষে দাঁড়ানো ছেলেটা বেশি নড়াচড়া করেছে। ওহ, তখন যে কেমন লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো তখন, এই অধমের জন্য মনে হয় টিকে থাকতে পারিনি প্রথম রাউন্ডে।

Share.

মন্তব্য করুন