জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল অয়ন। ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে ছিলো সামনের রাস্তার দিকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ছোটো ভাইটি এতোক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে বিরক্ত করে তুলেছিলো তাকে। প্রশ্ন করে করে তাকে অতিষ্ঠ করে তুলছিলো-
– ভাইয়া বল না মা কখন আসবে?
– আরে এখনি এসে পড়বে। তুই বরং এখন টিভি খুলে কার্টুন দেখগে, যা। অয়ন আবার ছোটো বারান্দাটুকুতে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় অয়নের। মা সেই সকালেই স্কুলে গেছে। যাবার সময় অবশ্য সারাদিনের খাবার টেবিলে দিয়ে গেছে। অয়নকে ডেকে বলেছে-
– শোন বাবা আমি খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে যাচ্ছি। তোরা দুই ভাই মিলে খেয়ে নিস।
– কেন মা? তুমি কখন ফিরবে? ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে অয়ন।
– অয়ন তুমি তো বড়ো হয়েছো। তুমি তো জানো যে আমি স্কুল ছুটির পর একটি কোচিং সেন্টারে কাজ করি। শুধু স্কুলের বেতন পেয়ে তো সংসার চলে না বাবা।
যাবার সময় অয়নের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খায় মা। তার পর দ্রুত পায়ে চলে যায়। অয়ন দরজা বন্ধ করে। মা বাইরে থেকে দরজায় তালা বন্ধ করে দেয়। বাসায় তারা দু’টি মাত্র ভাই সারাদিন একা থাকে। অয়নের বয়স এখন ছয়। ছোটো ভাই নয়ন পাঁচ বছরের। তাদের কারোরই এখনও স্কুলে ভর্তি হওয়া হয়নি। অবশ্য মা বাড়িতে দুজনকেই পড়াচ্ছে। মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। তারপর দ্রুত হাতে ঘরের কাজগুলো করে মা। খাবার টেবিল পরিষ্কার করে, বাসনপত্র ধোয়া তারপর তাদের দুজনের জন্য সামান্য নাস্তা খাইয়ে মা নিজে একটু খেয়ে নেয়। তারপর তাদের দুজনকেও পড়াতে বসে। মা বলেছে সামনের বছরই অয়ন আর নয়ন দুজনকেই মা তার নিজের স্কুলেই ভর্তি করে দেবে। অয়ন বলে তখন অনেক মজা হবে তাদের দু’ভাইয়ের। তাদের আর সারা দিন তালা বন্ধ হয়ে থাকতে হবে না। অবশ্য শুক্রবার দিনটি তাদের জন্য অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে। তাদের তিনজনের সংসারে সে দিনটি থাকে অনেক বর্ণিল রঙে রঙিন। মা ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের সমস্ত কাজ কর্ম করে তাদের দু’ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। সেদিন মা খুব সুন্দর করে পরোটা আর ডিম ভাজি করে নাস্তা দেয় তাদের। তারপর মা দুই ভাইকে সাথে নিয়ে বাজারে যায়। পছন্দের খাবার তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন সব কিনে আনে মা। সেদিন মা যতœ করে রান্না করে। দুই ভাইকে নিজের হাতে গোসল করায়। তারপর মা নিজে গোসল করে পরিপাটি হয়ে দু’ভাইকে নিয়ে খেতে বসে। সেদিন অয়ন মায়ের ভিজে চুল মুছে দেয়। মা ছম করে ধমক দেয়- আহ কি করছিস অয়ন?
– মা তোমার চুলগুলো কতো লম্বা আর সুন্দর।
– তোর চুলও খুব সুন্দর অয়ন।
– আমি তো ছেলে মা। আমার চুলতো তোমার মতো লম্বা হবে না। ছেলের পাগলামিতে মা হেসে উঠলো। তারপর খাওয়া দাওয়া হলে মা একটু গড়িয়ে নেয়। দু’ভাইকে অনেক গল্প বলে। স্কুলের গল্প, দেশের গল্প, ফেলে আসা দিনের গল্প। বাবার গল্প। বাবা নাকি দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর থেকে মা একা হয়ে যান। তাদের দু’ভাইকে সাথে নিয়ে মায়ের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। এসব গল্প শুনতে শুনতে অয়নের দু’চোখ ভিজে যায়। বাবার জন্য অয়নের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়। অয়ন আর নয়ন দু’ভাইকে খুব ভালোবাসে। তবু বাবার জন্য মন কেমন করে। আকাশের দিকে তাকায় অয়ন। আকাশে কতো তারা মিটমিট করে জ্বলছে। মা বলেছে যারা মরে যায় তারা নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। অয়ন মনে মনে ভাবে কোন তারাটি অয়নের বাবা? তার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে অভিমানে, কান্নায়। কেন চলে গেলে বাবা। আমরা যে বড়ো একা। টপটপ করে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে অয়নের। এমনি সময় আবার নয়নের কান্না শোনা যায়। দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে অয়ন।
– কিরে কাঁদছিস কেন?
– আমার বুঝি খিদে পায়নি?
– তাইতো আমারও খিদে পেয়েছে। চল আমরা বিস্কুট খাই। বলে অয়ন বিস্কুটের টিনটি নিয়ে এসে সেখান থেকে বিস্কুট বের করে একটি প্লেটে রাখে তারপর দুই ভাই মিলে বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে নেয়। এমনি সময় দরজার তালা খোলার আওয়াজ পায় অয়ন। দ্রুত পায়ে দৌড়ে যায় দরজার কাছে। ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয় অয়ন। মা ভেতরে ঢোকে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মা। অয়ন মাকে জড়িয়ে ধরে। মা আজ যে এতো দেরি হলো? মা বিষণœ হাসি হাসে। অয়নকে কাছে টেনে নেয়-
– ভয় পেয়েছিলি?
– তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিলো মা। তা ছাড়া নয়ন তোমার জন্য কাঁদছিলো।
– আসলে কি জানিস কাল তো ১লা বৈশাখ। স্কুলে অনেক বড়ো অনুষ্ঠান হবে। সে সব কাজ কর্মের জন্যই দেরি হয়ে গেলো।
– কী কী হবে সে অনুষ্ঠানে মা?
– এইতো সকাল থেকেই শুরু হবে অনুষ্ঠান। মন খারাপ হয়ে যায় অয়নের।
– কালও তুমি চলে যাবে?
– আরে কাল তো তোরা দুজনই আমার সাথে যাবি। আনন্দে উদ্বেল হয় অয়ন- সত্যি বলছো মা?
– আরে সত্যি। চল দেখি নয়ন কি করছে?
মা আর অয়ন মিলে ভেতরের ঘরে আসে। সেখানে টিভি চলছিলো। কিন্তু নয়ন ঘুমিয়ে পড়েছে। অয়ন দ্রুত নয়নকে জাগায়।
– আরে নয়ন ওঠ ওঠ। মা এসেছে। নয়ন ঘুম থেকে ওঠে মাকে জড়িয়ে ধরে যেন নিরাপদ আশ্রয় ফিরে পেয়েছে। নয়নের মা রেহানা দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতায় ভরিয়ে দিতে চায়। জীবন যুদ্ধ্রে জন্য তৈরি করতে চায়। নয়ন প্রচন্ড আবেগে মাকে বলে-
মা তুমিতো এতো দেরি কখনো করো না।
– হ্যাঁ বাবা, আজ একটু দেরি হয়েছে কারণ কালকে ১লা বৈশাখের বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। তাইতো এই দিনে আমরা সবাই মিলে নতুন বর্ষকে বরণ করবো। সবাই কাল বাইরে যাবো। স্কুলের অনুষ্ঠান দেখবো। দেখবে কতো মজা হবে। এবার অয়ন ও আনন্দে আপ্লুত হয়।
– মা আমাদের যে গতবারের সেই লাল সাদা ফতুয়াগুলো এবারও সেগুলোই পরবো মা। আর তুমি তোমার সেই লাল সাদা জামদানি শাড়ি পরবে। সেই শাড়ি পরলে যে তোমাকে কতো সুন্দর লাগে।
অয়নের মা ভাবেন এই ছোট্ট ছেলেটাও বাস্তব বুঝতে শিখে গেছে। তাই সে গতবারের কেনা ফতুয়াটার কথাটাই মাকে বলেছে। নতুন জামা কেনার বায়না সে ধরেনি বাস্তবের কঠিন কষাঘাতে ছেলেটা যেন সংসারকে বুঝতে শিখে গেছে। পরম আবেগে রেহানা জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে।
– হয়েছে আর এতো পাকামো করতে হবে না। এই দ্যাখ এবার আমি নতুন শার্ট আর প্যান্ট কিনে এনেছি তাইতো একটু দেরি হয়ে গেলো। অয়ন আর নয়ন লাফিয়ে ওঠে-
– তাই মা, দেখি দেখি নতুন কাপড়।
– এই দেখো লাল শার্ট আর সাদা প্যান্ট।
– তা তুমি নতুন শাড়ি কেনোনি মা?
– কি যে বলিস বোকা ছেলে। শাড়ি কি কখনো ছোটো হয়? তোদের গতবারের কেনা কাপড় যে ছোটো হয়ে গেছে। তবু অয়নের মন খারাপ হয়ে যায়। ওরা সবাই নতুন কাপড় পরবে আর মা পুরনো শাড়ি পরবে। মায়ের অনেক কথার মালা যেন অয়নকে আর আনন্দিত করতে পারে না। মায়ের তাড়া খেয়ে সবাই খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যায়। রাতে উত্তেজনায় বার বার ঘুম ভেঙে যায় অয়নের। মনে মনে স্বপ্ন দেখে সে লেখাপড়া করে অনেক বড়ো হবে। মাকে আর কষ্ট করতে দেবে না। মায়ের এই কষ্টের দিনগুলো রঙধনুর রঙে রাঙিয়ে দিবে। মাকে আর পুরনো শাড়ি পরতে দেবে না। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অয়ন। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে অয়নের-
– ওঠ অয়ন। সাতটা বেজে গেছে। আজ যে নববর্ষের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ।

Share.

মন্তব্য করুন