বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিজ্ঞান বই পড়ছিল স্বনন। বইটি হাতে নিয়েই জানালা দিয়ে থুথু ফেলতে গিয়ে দেখেÑ একটি উজ্জ্বল তারকা। আরে ওটা তো মঙ্গল গ্রহ! ওই যে উত্তর থেকে দক্ষিণে একটি আবছা পথের মতো দেখা যাচ্ছে ওটার নাম হলো ছায়াপথ। স্বনন বিজ্ঞান বইয়ে এসব পড়েছে; তাই দেখা মাত্রই সব চিনতে পারে। কোনটি ধ্রুবতারা, কোনটি সপ্তর্ষিম-ল সবই ও চেনে; অথচ আম্মু শুধু শুধু ওকে বকে- ‘গাধা নয়, গর্দভ তুই।’ আচ্ছা, গাধা আর গর্দভের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে? দুটো তো একই প্রাণীর নাম; কিন্তু আম্মু গাধা না বলে গর্দভ বলে কেন আমাকে? বিজ্ঞানে এ+ না পাওয়ায় এত বকাঝকা! বার্ষিক পরীক্ষায় দেখিয়ে দেবে। আজ রাতে আর না- ঘুম আসছে। বইটা বালিশের পাশে রেখে জানালার দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে স্বনন।
‘সাঁৎ’ করে কিসের যেন তীব্র আলোয় ওর চোখ ঝলসে যায়। চোখ রগরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকায়। দেখে- ওদের পাশের বাড়ির ছাদে একটি সসার ল্যান্ড করছে। গোলাকৃতি এ যানটি থেকে একটি প্রাণী নামছে। প্রাণীটি মানুষের মতো হেঁটে কাছে আসতেই স্বনন দেখল- মানুষ আর বাদুড়ের চেহারার সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক জীব- অনেকটা কার্টুনের ব্যাটম্যানের মতো। ও বুঝল এটা অন্য গ্রহের জীব অর্থাৎ এলিয়েন।
এলিয়েন স্বননের জানালার কাছে এসে বলল, কেমন আছো স্বনন? তোমার মন খুব খারাপ বুঝি?
আরে! ও দেখি আমার নামও জানে; আমার মন খারাপ তাও জানে। ও অন্তর্যামী নাকি? স্বনন শুনেছে এলিয়েনরা খুব উন্নত এবং বুদ্ধিমান প্রাণী। টেলিপ্যাথি ক্ষমতা আছে ওদের।
– কী ভাবছো স্বনন? তুমি কি আমাদের সাথে ভ্রমণে যাবে?
স্বননের মহাবিশ্ব ভ্রমণের অনেক দিনের শখ। মনে হয় এ কথাটাও ওরা জানে। তাই নীরবতা ভেঙে কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে বলে, কোথায়?
– M-7 গ্রহে; যেখানে আমরা থাকি।
-কতদূর এ গ্রহ?
– তোমাদের সৌরজগৎ থেকে আরো ৬টি সৌরজগৎ পাড়ি দিয়ে আমাদের গ্রহে যেতে হয়।
– এত দূর! এ তো কয়েক শ’ বছর লেগে যাবে।
– তা ঠিক। তোমাদের পৃথিবীর নভোযানে গেলে কয়েক শ’ বছর লাগবে; তবে তোমরা এখনো আমাদের গ্রহে যাওয়ার জন্য এমন কোনো নভোযান তৈরি করতে পারো নি। আমরা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তোমাকে নিয়ে যেতে পারব।
– ওখানে নিয়ে গিয়ে তুমি আমাকে কী কী দেখাবে?
– ওখানে তোমাকে অদ্ভুত সব জিনিস দেখাব। অতীত ভবিষ্যৎ সব জায়গায় তোমাকে ভ্রমণ করাবো।
– বলো কী! সত্যি?
– আগে চলই না আমাদের সাথে।
স্বননের মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। আম্মুর কাছে ও বোকা গর্দভ। এলিয়েনের দেশে থেকে সব কিছু শিখে ও বিজ্ঞানী হয়ে ফিরবে।
– চলো তাহলে। এলিয়েন স্বননের হাত ধরার সাথে সাথে জানালার শিকগুলো কলাপসেবল গেটের শিকের মতো একদিকে সরে গিয়ে দরজার মতো ফাঁকা হয়ে যায়। এর পর ওকে নিয়ে সসারে উঠে পড়ে।
সসার বিদ্যুৎগতিতে চলতে থাকে। চোখের পলকে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সসারটি।
– M-7  গ্রহে এসে সসারটি থামে। কয়েক শ’ আলোকবর্ষে পথ পেরিয়ে এসেছে সসারটি, কিন্তু সময় লেগেছে মাত্র এক ঘণ্টা দশ মিনিট। এলিয়েন স্বননের হাত ধরে নামাতে নামাতে বলে, তোমার কি খুব খিদে পেয়েছে?
– খুব পায় নি; তবে…
– তুমি কী খাবে?
– একটু জুস দিতে পারো।
– এখানে তো পৃথিবীর কোনো খাদ্য পাওয়া যায় না। আর আমরা তো কোনো তরল বা কঠিন খাবার খাই না। আমরা শুধু বায়বীয় খাবার খাই।
– সেটা আবার কেমন?
– আলো, বাতাস এগুলো খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি।
– বলো কী!
– হ্যাঁ, এর অনেক সুবিধে; এতে শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা বেশি হয়। আবার সময়েরও অপচয় হয় না।
– মানে?
– মানে তোমাদের মতো আমরা প্র¯্রাব-পায়খানা করি না।
স্বনন অবাক নয়নে এলিয়েনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না।
এলিয়েন ওর মনোভাব বুঝতে পেরে বলে, কোনো অসুবিধা নেই। এ গ্রহে তুমি আমাদের খাদ্য খেয়েই বেঁচে থাকতে পারবে। এসো তোমাকে কিছুটা পেট ভরে খাবার খাইয়ে মনটা প্রফুল্ল করে দেই। বলে এলিয়েন স্বননকে সাথে করে নিয়ে একটি রুমে ঢুকে পড়ে।
রুমটি বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। কিছু যন্ত্র থেকে টিমটিম করে আলো জ্বলছে; আর কিছু যন্ত্র থেকে শনশন করে মৃদু-মন্দ হাওয়া বেরুচ্ছে।
এলিয়েন বলে, তুমি হালকা খাবে নাকি ভারী খাবার খাবে?
স্বনন বলে, হালকা।
যেখানটায় টিমটিম করে আলো জ্বলছিল এলিয়েন সেখানে গিয়ে ছোট একটি টর্চলাইটের মতো যন্ত্র নিয়ে এসে স্বননের পেটে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর যন্ত্রটি সরিয়ে নিয়ে বলে, এখন কি খিদে অনুভূত হচ্ছে?
স্বনন ঘাড় নেড়ে না-বোধক জবাব দেয়।
– এখন বলো তুমি আগে কোথায় যাবে; অতীত না ভবিষ্যতে?
– সে দেশ কোথায়?
– আমাদের পাশের সৌরজগতের গ্রহ ঔ-১৩-এ তোমাদের পৃথিবীতে অতীতের সব মানুষজনকে দেখতে পাবে। যেমন তোমার মৃত আত্মীয়-স্বজনÑ দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রমুখ পূর্বপুরুষকে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গকেও দেখতে পাবে; যেমন- স¤্রাট বাবর, হুমায়ুন, আকবর, নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ, মিরজাফর প্রমুখ।
স্বনন অবাক কণ্ঠে বলে, তাই নাকি! আর ভবিষ্যতে?
– আমাদের গ্রহেই আছে তোমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যতের মানুষজন। মনে করো তোমার বা তোমাদের পরিবারে ভবিষ্যতে কে কে আসবে অর্থাৎ এখানে তোমার উত্তর-পুরুষদের দেখতে পাবে।
স্বনন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে এলিয়েনের কথায়। তাহলে চলো আমরা আগে অতীতের গ্রহে যাবার জন্য প্রস্তুত হই।
এলিয়েন স্বননকে নিয়ে একটি ধবধবে সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। স্বনন রূপকথার গল্পে এমন ঘোড়ার ছবি দেখেছে কিন্তু বাস্তবে এমন একটি সুন্দর পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে ও চড়বে তা কল্পনায়ও আসেনি।
পক্ষীরাজ ঘোড়াটি বাতাসের গতিতে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলছে। গ্রহ-নক্ষত্রের আলো ঝলমল করছে চারিদিকে। সামনে অসীম শূন্যতা। পক্ষীরাজ চলছে তো চলছেই।
প্রথমে স্বননের ভালো লাগলেও হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। এতক্ষণ মহাকাশে আলো থাকলেও ক্রমশ অমাবস্যা রাতের মতো গাঢ় অন্ধকার নেমে আসছে। স্বনন কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে এলিয়েনকে জিজ্ঞেস করল, এত অন্ধকার কেন; কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না?
এলিয়েন হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, কথা বলো না। আমরা কৃষ্ণগহ্বর পাড়ি দিচ্ছি।
স্বনন বিজ্ঞান বইয়ে কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে পড়েছিল। এটা ভয়ঙ্কর এক জায়গা। এর কোনো কূলকিনারা নেই; একবার ঢুকলে আর বেরোনো যায় না। স্বনন আরো ভয় পেয়ে গেল। বলল, চলো আমরা ফিরে যাই।
কিন্তু এলিয়েন নীরব। ওর নীরবতায় স্বননের মনে এক অজানা আশঙ্কা জমাট বেঁধে উঠল। তাহলে কী…
-ঠিকই ধরেছে। তোমাকে আমি এই কৃষ্ণগহ্বরে ফেলে চলে যাবো। হাঃ! হাঃ!! হাঃ!!! হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এলিয়েন। হাসি থামিয়ে বলে, আমরা শুনেছি পৃথিবীর মানুষেরা খুব খারাপ। তাদের উপযুক্ত শাস্তির স্থান- এটাই। বলে এলিয়েন স্বননকে এক ধাক্কা মেরে পক্ষীরাজ ঘোড়া থেকে গভীর কালো শূন্যতায় ফেলে দেয়।
স্বনন ভয়ার্ত কণ্ঠে আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে, না…!
স্বননের চিৎকারে মা পাশের রুম থেকে দৌড়ে এসে দেখে- ও মেঝেতে পড়ে আছে। মা স্বননের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কি রে, দুঃস্বপ্ন দেখেছিলি?
স্বনন দু’হাতে চোখ রগরিয়ে নিয়ে মায়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন