বসন্ত মানেই নতুন কিছু।
বসন্ত যেন ভালোবাসার প্রতীক। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে নতুন কিছুর জন্ম হয়।
প্রকৃতি যেন সব দিকে জ্বালিয়ে দেয় নতুন আলো।
শীতের রিক্ত রুক্ষ বিবর্ণতায় আমাদের মাঝে আসে বসন্ত।
আলোময় হয়ে ওঠে আকাশ, চারপাশ পুলক বয়ে আনে স্নিগ্ধ শীতল মৃদুমন্দ বাতাস।
ফুলে ফলে নতুন রূপে শোভিত হয় প্রকৃতির বুকে রঙিন উচ্ছ্বাস।
বসন্ত তাই যৌবনেরও প্রতীক।
বসন্ত আমাদের নিত্যদিনের একঘেয়ে বৈচিত্রহীন জীবনে বিপর্যস্ত পরিবেশে কি রূপান্তরই না ঘটিয়ে দেয়।
হালকা রোদ কিন্তু শীতল বাতাস এ এক ভারি আশ্চর্য জাদু।

কবি সুফিয়া কামাল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘তাহারেই মনে পড়ে’ কবিতায় বসন্তের কথা বলেছেন এভাবে-
‘হে কবি নীরব কেন ফাগুন এসেছে ধরায়,
বসন্ত বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি- দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
ঊাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?’
ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ জীবনে তারুণ্যের উদ্ভাসন দেখেছেন বসন্তে; অনুভব করেছেন হৃদয়ের অনুরাগ দ্বীপ্ত জাগরণে-
‘বনানী সেজেছে সাকি ফুলের পেয়ালা হাতে
তুহিন শীতের শেষে দেখি আজ মুক্ত রূপ তার,
গাছে গাছে, ডালে ডালে তারুণ্যের জেগেছে জোয়ার;
জেগেছে ফুলের কুঁড়ি অরণ্যের মদিরা বিলাতে ।’
[ফাল্গুনে : মুহুর্তেও কবিতা]
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখায় বসন্তের সৌন্দর্য বর্ণনা দেখেছি-
‘ফুটিল বকুল ফুল কেনগো গোকুলে আজি কহনা স্বজনি?
আইল কি ঋতুরাজ? ধরিল কি কুলসাজ বিলাসে ধরণী?
মুছিয়া নয়ন জল চল গো সকলে চল…।’
ইংরেজ কথাশিল্পী চার্লস ডিকেন্স লিখেছেন বসন্ত দুই ঋতু মিলিয়ে এক ঋতুতে পরিণত হয়েছে ।
এর আলোর উজ্জ্বলতা গ্রীষ্মের আর স্নিগ্ধছায়া শীতের। এমন যুগল মাধরীর কারণেই এ ঋতু এত মনোরম, এত উপভোগ্য।
বাংলা সাহিত্যের নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় বসন্ত ধরা পড়েছে-
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরোনা বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয় দল খুলিয়ো,
আজ ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো,
এই সঙ্গীত মুখরিত গগনে
তব গন্ধ কর হিয়া তুলিয়া॥’
অনলপ্রবাহের কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী তার কবিতায় বসন্তের জয়গান গেয়েছেন এমন করেÑ কুহেলি ভেদিয়া
‘জড়তা টুটিয়া
এসেছে বসন্তরাজ।
নবীন আলোকে
নবীন পুলকে
সাজিছে ধরণী আজ।’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শেখ ফজলল করিম বসন্তকে আহবান জানাচ্ছেন এভাবে-
‘এসো এসো ঋতুর রাজা
ধর মোদের স্নেহতাজারে
বল কোথায় বছর ভারে
ফুল ফুটলে কেমন করে হে
বাংলা মায়ের কানন ছেড়ে
সুখ পাও কি দুনিয়া কিরে হে।
আমাদের বাগান, করো আলো
ভোরেই এসো বনের রাজা
ফুল দিও ভাই তাজা যে।’
কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় বসন্ত এঁকেছেন যেভাবে-
‘বসন্তের ঝড় আর শিলাবৃষ্টির ঝাপটা থেকে
যদি অমৃত ফলের এ মন্জুরীগুলি বয়ে যায়,
আসন্ন গ্রীষ্ম ও বিপন্ন বর্ষায়
তবে আমাদের আমের অভাব হবে না।
হে বসন্ত, তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো
আমি তোমাকে আমার পরাণ ভরিয়া আঁকি।’
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতায় শুনি-
‘বসন্ত বিকাশের অজস্রতার একাত্ম হওয়ার আহবান-
যেমন আয়রে বসন্ত তোর কিরণ পাখা তুলে।
নিয়ে আয় তোর কোকিল পাখির গানের পাতা গানের ফুলে।’
বসন্ত নিয়ে কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন-
‘একুশ শতকের এই দীর্ঘ শীত পারি দেওয়ার জন্য
আর কত হিমযুগ পার হতে হবে আমাকে,
বসন্ত তোমার হাতবাক্সে কি সেই উত্তর লেখা আছে?’
কবি হাসান আলীম বসন্তকে আহবান জানিয়েছেন ব্যতিক্রমভাবে।
তার সহজ ভাষায়-
‘বসন্তে আসুক তীব্র ঝড়
লোকালয় ভিজে যাক শীতল বৃষ্টির
অবিরাম ধারাবর্ষণ আনন্দে
ভরে যাক বসন্ত পীড়িত এই পুরনো পৃথিবী।’
বসন্ত নিয়ে ফজল শাহাবুদ্দীন লিখেছেন-
‘ঘরের ভেতর কালোমাটি মাছের চোখে নীল
সন্ধ্যা হলে তারার মেলা রাত্রিরা ঝিলমিল
রোদের নিচে চিলের ডানা বসন্ত যায় উড়ে
জানে না সে যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে কর দূরে।’
এমনকি জার্মান কবি রাইনের মারিয়া রিলকে লিখেছেন- ‘বসন্ত এলে পৃথিবী আমোদিত আহ্লাদিত হয়ে ওঠে কবিতা জানা শিশুদের মতোই।’
কবি মোশাররফ হোসেন খানের কবিতায় বসন্ত এসেছে এভাবে-
‘দখিন হাওয়া নিয়ে এলো বসন্ত
চারদিক কোলাহল, উঠেছে সেজে নব দিগন্ত!
বসন্ত কি এনেছে সবুজ পাতা?
কেন যে ভরে যায় আমার কবিতার খাতা?’
এমনি ভাবেই বাংলা-সাহিত্যের অনেক নামীদামি জ্ঞানীগুণী নবীন- প্রবীণ কবি-সাহিত্যকগণ বসন্তের বর্ণিল শোভায় মুগ্ধ হয়ে প্রাণ উজাড় করে লিখেছেন বসন্তের কবিতা। আসলেই বসন্ত কবিতার ঋতু।
বসন্ত এ দেশের কবিদের হৃদয়কে আলোড়িত করে। তাই বর্তমানে আমরা কবিতায় বসন্ত নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাবো।

Share.

মন্তব্য করুন