ছোট্ট জোবায়েদ। কত আর হবে বয়স, ছয় কিংবা সাত। এ বয়সে তার কোমল হৃদয়ে নানা স্বপ্ন দানা বেঁধে আছে। আছে অতীত স্মৃতির কিছু নিদর্শনও। গত ঈদুল আযহার দিন ও যেমন নতুন পোশাক পরে আনন্দ পেয়েছিল, তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিল পশু কোরবানি করতে দেখে। সারা দিন ঘুরে ঘুরে কোন বাড়িতে কী কোরবানি হলো, কোন গরুর কী রং, কয়টি ভেড়া, কয়টি ছাগল কোরবানি হলো, কোন গরুর কতটুকু মাংস ইত্যাদি নিয়ে ওর কৌতূহলের শেষ নেই। এমনকি ঈদের দিনের রকমারি খাবারের কথাও ভুলে গিয়েছিল সে। এ জন্য অবশ্য ঈদের দিনেও মায়ের বকা ঝকা খেতে হয়েছে ওকে। প্রতিটি গরুর আবার রঙ চেহারার ওপর ভিত্তি করে একেকটার নামও দিয়েছে সে। কালো গরুর নাম দিয়েছে কালাচান, লালটার লালচান আর ধলাটার ধলাচান। গত বছর জোবায়েদের বাবা একটি কালো গরু কোরবানি করেছিলেন তাতে ওর মন ওঠেনি। তাই সেই থেকে, সে বায়না ধরেছে বছরের শুরুতেই একটি লাল গরু তার চা-ই। যেটাকে সে দাদার সাথে সযতেœ লালন পালন করবে। কারণ সে মসজিদের ইমাম সাহেবের নিকট শুনেছে নিজের হাতে লালিত পালিত নাদুস নুদুস দৃষ্টিনন্দন পশু কোরবানি করলে আল্লাহ বেশি খুশি হন। তা ছাড়া ইমাম সাহেব নাকি এও বলেছেন, যে পশু বেশি মহব্বতের সাথে পালিত হয় তার প্রতি নাকি একটা আত্মিক মহব্বত সৃষ্টি হয়, আর মহব্বতের পশু কোরবানি করলে আল্লাহ বেশি খুশি হন। তাই জোবায়েদের কথা মতো বছরের গোড়ার দিকেই একটি উঠতি বয়সের লাল ষাঁড় বায়রার হাট হতে ক্রয় করে এনেছেন ওর বাবা। আর কিনবেনই না কেন, হাজার মানুষের দাবি পূরণ না করলেও অন্তত জোবায়েদের দাবি পূরণ করবেনই। গরু দেখে ওর আনন্দ আর ধরে না। তাই আদর করে ওটার নাম দিয়েছে ‘চিতকপালি লালচান’। লালচান ছাড়াও এখন আর কিছুই বোঝে না। ওর দাদার সাথে প্রতিদিনই ও লালচানকে গোসল করাবে, রকমারি খাবার খাওয়াবে। খাইতে না চাইলে ও ষাঁড়টির ঝুলানো লম্বা লতি ধরে আদর করে, কখনো বা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে-খা, খা খড়ের পোলাও খা, ভুষির পায়েস খা, আরো কত কী বলে বলে ও লালচানকে খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে লালচান খাবার নিয়ে অভিমান করলে জোবায়েদ আদর করে ওর কানের কাছে গিয়ে কী যেন ফিস ফিস করে বলে, এতে ওর অভিমান ভেঙে সুবোধ বালকের মত খাবার খায়। লালচান ও জোবায়েদের মধ্যে একটা সখ্য গড়ে উঠেছে। উভয়ের মধ্যে যেন মানিকজোড়। একজন আরেক জনকে ছাড়া যেন এক মুহূর্তও বাঁচবে না। এইতো সেদিন রাতে কি কা-টাই না ঘটে গেল। ঘুমন্ত জোবায়েদ হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠলো লালচান লালচান বলে। আমার লালচান মরে গেল, তাড়াতাড়ি ফিরাও। নইলে আমার লালচান যে মারা যাবে বলেই হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল। ততক্ষণে রীতিমত একটা হুলস্থূল লেগে গেল সারা বাড়ি জুড়ে। সকলেই দৌড়ে এল কী হয়েছে জোবায়েদ কী হয়েছে তোমার। জোবায়েদের কথামত লালচানের ঘড়ে গিয়ে দেখা গেল লালচান দিব্বি ঘুমাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো গত সপ্তাহে জোবায়েদের দাদা লালচানকে গোসল করাতে নিয়ে ছিল নূরানী গঙ্গার ঘাটে। এ ঘাটটিই নাকি মানিকদহ, বাঙ্গালা, কালিয়াকৈর ও চড় মগড়ার সব মানুষের গরু ঝাপানোর একমাত্র ঘাট। লালচান গোসল সেরে যখন নদীর পাড়ে একেবারে উপরে উঠে এল ঠিক তখনই বাঙ্গালার হাসেম শেখের ষাঁড়ের সাথে হঠাৎ করেই লেগে গেল লড়াই, তুমুল লড়াই। একদিকে লালচান ভ্যাঁ শব্দ করে অন্যদিকে হাসেম শেখের ষাড়টিও ভ্যাঁ করে পিছু হঠতে থাকে। এভাবে চলতে থাকে লড়াই, তুমুল লড়াই। কেউ কাউকে ধরাশায়ী করতে পারছে না। এ দৃশ্য দেখে জোবায়েদ চিৎকার করে বলতে লাগল- বাঁচান আমার লালচানকে বাঁচান।
যা হোক, সে দিনের লড়াই থামলেও থামেনি জোবায়েদের আর্তচিৎকার। সে মাঝে মধ্যেই ঘুমের ঘরে চিৎকার করে ওঠে। সারা বছর দাদার সাথে লালচানকে লালন পালন করে নাদুস নুদুস করে তুলেছে সে। আজ দশই জিলহজ, ঈদুল আজহা, কোরবানির ঈদ। আজ ওকে কোরবানি করতে হবে। জোবায়েদ দাদার সাথে অতি প্রত্যুষে লালচানকে গোসল করিয়েছে, শিংয়ে তেল লাগিয়েছে, গায়ে হাত বুলিয়ে পশমগুলো মিল করে দিয়েছে, যা রোদের আলোতে ঝলমল করছে। শিং এ মালা পরিয়ে লালচানকে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে ঠিক যেন নব দুলহান। আর দেরি নয় সেই কাক্সিক্ষত ক্ষণ উপস্থিত। লালচানের পায়ে রশি লাগিয়ে দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে পিঠের ওপর দিয়ে পেছনের দুই পায়ের মধ্য দিয়ে টান দেয়া হলো লালচানকে শোয়ানোর জন্য। কিন্তু শত চেষ্টা করেও লালচানকে শোয়ানো গেল না। লেগে গেল আরেক দফা হুলস্থূল। তাহলে কী করে ওকে কোরবানি করা যায়। সকলেই হতাশ, ঠিক এমন সময় জোবায়েদের দাদা জোবায়েদকে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো। তখনো লালচানের লাফালাফি থামেনি। জোবায়েদ আস্তে আস্তে লালচানের কাছে গেল। লালচান এবার লাফালাফি বন্ধ করে সুবোধ বালকের মত স্থির কদমে দাঁড়িয়ে গেল। জোবায়েদ লালচানের গলা ধরে কানের কাছে ফিস ফিস করে কী যেন বলল। লালচান আর দেরি করল না সে ধীরচিত্তে শুয়ে পড়ল মাটিতে। সকলেই কৌতূহল ভরে চেয়ে রইল জোবায়েদের দিকে। যেখানে শত জোয়ান শত চেষ্টা করেও লালচানকে শোয়াতে পারল না সেখানে জোবায়েদ কি এমন মন্ত্র পাঠ করল যে, লালচান সুবোধ বালকের মত শুয়ে পড়ল মাটিতে। সকলেই নাছোড়বান্দা। জোবায়েদকে এর রহস্য বলতেই হবে। এবার অশ্রুসিক্ত নয়নে জোবায়েদ বলল- শোন তা হলে, লালচানের সাথে আমার এক গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর কারো কথা মান্য না করলেও জীবন দিয়ে হলেও আমার কথা সে মান্য করবেই। আমি ওকে বললাম- শোন লালচান, আমার তোমার তথা বিশ্বভ্রহ্মা-ের সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশে তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে কোরবানি হতে হবে। তোমাকে আল্লাহ খুব পছন্দ করেছেন। সত্যি তো মহান আল্লাহ যদি আমাকে পছন্দ করে থাকেন, তা হলে এর চেয়ে খুশির সংবাদ আর কী হতে পারে? এ কথা বলেই লালচান মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য শান্তভাবে শুয়ে পড়ল মাটিতে। জোবায়েদ বলল- লালচান তোমার সাথে যেন আমার পরকালে চির সুখের স্থান, জান্নাতে দেখা হয়।

Share.

মন্তব্য করুন