আজ তাসফিয়ার মনে অনেক আনন্দ। আজ কী যে ভালো লাগছে তার! মনে হয় আনন্দে শাঁই শাঁই করে আকাশে উড়ছে সে। স্কুল ছুটির পর দ্রুত বাসায় ছুটে যায় ও। বুকে ইংলিশ খাতাটি জড়িয়ে ধরে আছে গভীর মমতায়, ভালোবাসায়। মুখে রাজ্য জয়ের হাসি।
বাবাকে খাতা দেখাবে সে।
মাকেও দেখাবে।
আপুকেও দেখাবে।
বাসায় গিয়ে বাবাকে খোঁজে। বাবা নেই।
মাকে খোঁজে। মাও নেই।
আপুও নেই।
আজ বাসার সব কিছুই কেমন যেন অচেনার মতো লাগছে। বাসার সব কিছু এলোমেলো। এদিক ওদিক ছড়ানো আর ছিটানো। এক অজানা ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে তার। বাবা বাবা, মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে।
তাসফিয়া তাসনিম আরাকান রাজ্যের এক রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারের মেয়ে। আরাকানের স্বনামধন্য এক কিন্ডারগার্টেনে নার্সারিতে পড়ে সে। আজ স্কুলের টিচার তার খাতায় সুন্দর করে লিখে দিয়েছেন ভেরি গুড। সেই ভেরি গুড পেয়ে তার কী যে আনন্দ! কী যে খুশি! খুশি হবে না? এর আগে কত্ত কত্ত সুন্দর আর নির্ভুল লেখা লিখেছে সে, তবুও কোনো দিন ভেরি গুড তো দূরের কথা গুডও পায়নি ও। অথচ তার চেয়ে কত খারাপ আর ভুল বানান লিখে তার বান্ধবীরা গুড আর ভেরি গুড পাচ্ছে। বান্ধবীদের খাতায় গুড আর ভেরি গুড দেখে তার মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ করে বাসায় ফিরে সে। বাসায় ফিরে কারো সঙ্গে কথা বলে না।
বাবার সাথেও না।
মায়ের সঙ্গেও না।
আপুর সঙ্গেও না।।
মেয়েকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বাবা বুঝতে পারেন আজও হয়তো স্কুলে কিছু হয়েছে। যার জন্য মেয়ের মন খারাপ। বাবা এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করেন। মুখে চুমু খেয়ে বলেন, মা মণি, কী হয়েছে তোমার?
তাসফিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবা, আজ আমার বান্ধবীদের সবার খাতায় স্যার গুড দিয়েছে, শুধু আমার খাতায় গুড দেয়নি।
মামণি, তুমি হয়তো কোনো ভুল করেছ, সে জন্য গুড দেয়নি।
ভুল করিনি বাবা।
তুমি হয়তো ভুলটা বুঝতে পারছো না।
কোনো কথা না বলে তাসফিয়া দৌড়ে ঘরে যায়। সব খাতা বের করে বাবাকে দেখায়। বাবা মেয়ের খাতা দেখেন, খাতায় কোনো ভুল নেই। নির্ভুল বানান। কাটা কাটা অক্ষরে সুন্দর আর ঝকঝকে লেখা।
ভুল করেছি বাবা?
করোনি মামণি।
তাহলে স্যার আমাকে গুড দিলো না কেন?
তুমি মুসলিম তো, তাই।
মুসলিমদের বুঝি গুড দেয় না।
একদিন দেবে মামণি। বলে আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বাবা।
বাবার কথা সত্যি!
কিছুদিন পর স্কুলে এক নতুন স্যার জোগদান করেই তাসফিয়ার লেখা দেখে সুন্দর করে খাতায় ‘ভেরি গুড’ লিখে দিলেন। ভেরি গুড পেয়ে তাসফিয়া খুব খুশি হলো। যাকে বলে একেবারে আনন্দে বাকবাকুম।
স্কুল ছুটির পর দ্রুত বাসায় ফিরে সে।
বাবাকে যে ভেরি গুড দেখাতে হবে ?
কিন্তু বাসায় এসে কাউকে খুঁজে পেল না সে।
বাবাকেও না।
মাকেও না।
আপুকেও না।
সে স্কুলে যাওয়ার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে তা-ব চালিয়েছে। কাউকে গুলি করে হত্যা করেছে। কাউকে ধরে নিয়ে গেছে। তাসফিয়ার বাবা, মা ও আপুকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে নাকি ধরে নিয়ে গেছে তাসফিয়া জানে না। সে শুধু জানে বাবা মা, আপু একদিন আসবে তার খাতার ভেরি গুড দেখবে।
বাবাকে ভেরি গুড দেখানোর জন্য তাসফিয়া আজও খাতা বুকে জড়িয়ে ধরে থাকে।
বাংলাদেশে এসেও।
ত্রাণ নেয়ার সময় লাইনে দাঁড়ানোর সময়ও তার বুকের একপাশে লেপ্টে থাকে ওই খাতা।

 

Share.

মন্তব্য করুন