(গত সংখ্যার পর)

সারাবাড়িতে সবাই চুপচাপ। হক সাহেব এই মাত্র এলেন ব্যর্থ খোঁজাখুঁজি করে। কত হয়রানি যে শাহীন করে চলেছে তাদের। রাগে দুঃখে তার বুকটা ফেটে যেতে চায়। মিসেস হকেরও একই অবস্থা। তিনি ভাবছেন আরও একটা বিষয়। এ নিয়ে শাহীন কতবার হারাল। নিম ফকির বলেছিল ছেলেটার ওপর একটু জিনের প্রভাব আছে। একটু সাবধানে, চোখে চোখে রাখবেন। এবার হারালে পাওয়া কষ্ট হবে। এ কথা ভেবেই আঁচলে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকেন তিনি। বিটু মলিন মুখে মার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিঠু খাতায় আঁকি বুকি করতে থাকে।
বিকেলে বাবু এলো। খেলবি না? মিঠু ‘না’ বলে দেয়। তারপর বেলী আপার সঙ্গে এলো শেলী। শেলী দু’ভাইকে সান্ত¡না দেয়-
: মন খারাপ করো না। এবারও দেখ ঠিক ঠিক ফিরে আসবে।
বাবুর আম্মা, টিপুর আম্মা, শেলীর আম্মা-এক এক করে সবার আম্মাই আসেন। একেকজন একেক রকম কথা বলেন। কেউ বলে-ছেলেটাকে শাসন বেশি করা হয়, কেউ বলেন ‘কম’, কেউ বলেন এবার নিশ্চয় ছেলেধরার পাল্লায় পড়েছে। তারপর মাইকিং, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আর বেতারে নিখোঁজ সংবাদ দিতে বলেন। মিঠুর আম্মা চুপচাপ শোনেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

হক সাহেব খোঁজাখুঁজি শেষ করে রাত বারোটায় বাসায় ফেরেন। সে রাতে মিঠুদের ঘুম হয়নি। মাঝ রাতে মা কোরআন শরীফ পড়েন। বাবা এপাশ ওপাশ করেন। কতবার শাহীন হারিয়ে গেছে। কিন্তু কখনো বাড়ি ছাড়েনি। শুয়ে মিঠু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে দাদার কথা। কোথায়, কোন দূরে একা একা হারিয়ে গেল দাদা, একটু বলেও গেল না। মিঠুর মনে পড়ে চা বাগানের ছবির কথা। ওই ছবির মত কোন ঠিকানায় হারিয়ে গেল নাতো দাদা?

কত কষ্টে রাত কেটে যায় ওদের। এত সুন্দর ভোরেও খুব উদাস উদাস লাগে। কি এক শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে ওদের হৃদয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিঠু। নাসিমা আপা দু’বোনকে নিয়ে ব্রাশ করতে করতে মর্নিং ওয়াকিং করছে। বসন্তের এ সময়টা হাঁটতে কি যে ভালো লাগে! শেলী মাথা ঝেঁকে কি যেন ইশারা করে। হয়ত জানতে চাচ্ছে-দাদা এসেছে কিনা। মিঠুও মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয়-আসেনি। শেলী হাত ইশারায় ডাকে। মিঠু মাথা নেড়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। বিটু বেরিয়ে যায় ব্রাশ নিয়ে। কিছুক্ষণ পর মনুকে দেখা গেল বাড়ির আশপাশে। মিঠুর বাবাকে মনু এড়িয়ে চলে। খুব ভয় লাগে। কি-না ‘কি’ জিজ্ঞেসা করে ফেলে।
খুব ভোরে মিসেস হক যাবেন নিম ফকিরের কাছে। অশীতিপর এই বৃদ্ধ ফকির আয়না পড়া জানেন। আয়নাতে নাকি দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া ছেলের আবছা কায়া। সেই কায়া সুখে আছে না দুঃখে আছে-তা বলে দেবে ফকির। তাই জানতে যাবেন মিঠুর আম্মা। মিঠুকে নিয়ে বের হন তিনি। সূর্য ওঠার আগেই ধরতে হবে নিম ফকিরকে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আসলাম সাহেব এলেন মিঠুদের বাসায়। শাহীনের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করলেন। পরামর্শ দিলেন কি করতে হবে। আর নিজের ছেলের দস্যিপনার জন্য বিব্রতবোধ করলেন। জানালেন-ওকে আমি হোস্টেলে অথবা রাজশাহীতে ওর খালার কাছে পাঠিয়ে দেবো।
ব্রাশ করতে করতে শেলীরা চলে আসে বড় রাস্তার মোড়ে। কি নীরব রাস্তা! নাসিমা’পা ব্যাক-টার্ন নিলেন। শেলী আর বিটু বক্ বক্ করছে।
: জানো, আব্বা না কোয়ার্টার পেয়েছে
: সেটা আবার কী?
: কোয়ার্টার মানে সরকারি বাসা।
: কোথায়?
: অনেক দূর। রায়ের বাজার।
: আমরা খুব একা হয়ে যাব, শেলী আপা।
: তোমার ভাইয়াকে নিয়ে বেড়াতে আসবে।

সরলমনা বিটুর মনটা ভেঙে যায়। দূর! সবাই শুধু চলে যায় আর হারিয়ে যায়। এই সেদিন, গ্রাম থেকে নানা-নানী এলো। দু’দিন না যেতেই বললেন-যেতে হবে। শেষে চলেই গেলেন। কেউ চলে গেলে বিটুর খুব কান্না পায়। কাঁদেও খুব। বুকের মধ্যে হাহাকার করে। কণ্ঠনালীতে ব্যথা অনুভূত হয়।
নিম ফকির মিঠুর মাকে জানালো যে, এখান থেকে শত শত মাইল দূরে আছে ছেলেটা। একজন দরবেশ মত লোক ওকে আশ্রয় দিয়েছে। শুনে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করলেন মিসেস হক।

 

সময় গড়িয়ে যায়। জীবনতো থেমে থাকে না। তাই মিঠুরা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবু মিঠুর আম্মা মাঝে মাঝেই শাহীনের কথা বলেন আর কাঁদেন। টানাটানির সংসারে ছেলের পেছনে নগদও গেছে কিছু। এ টাকায় বেতারে আর কাগজে নিখোঁজ সংবাদ দিতে হয়। কিন্তু মাস পেরুলেও কোনো হদিস মেলেনি শাহীনের। শুধু মনের সান্ত¡Íনা নেয়ার জন্য মিঠুর আম্মা মাঝে মাঝে যান নিম ফকিরের কাছে। তাতেও দু’পয়সা খরচ করতে হয়।
মিঠু আর বিটু মাঠে খুব কম বেরোয়। একদিন বাবু, নাসির আর টিপু বলল- এভাবে ঘরের মধ্যে বসে থাকলে ভূত হয়ে যাবি। সেই থেকে দু’ভাই মাঠে নামে। অবশ্য ছোট্ট বিটু বাবুর সঙ্গে তর্কই বাধিয়ে দেয়।
: খেলি না মানে, কি বলছ তুমি বাবু ভাই, খেলিতো।
: কি খেলো?
: লুডু, কেরাম, দাবা।
: ও, ওই শেলীদের বাসায়? আরে ওগুলোতো মেয়ে মানুষের খেলা।
: খেলাতো খেলাই। ছেলেমেয়ে আবার কি!
: না তোমরা ওই হিংসুটে মেয়েটার সঙ্গে খেললে আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো না। খেলবোও না।

শেলীর কথা বাবু একদম শুনতে পারে না। শেলী নাকি একদিন ওকে ঢাকাইয়া কুট্টি বলেছে। আর একদিন বলেছিল ‘পিচ্চি বাবু’। পিচ্চি বাবু আবার কী! বাবু কি এখানে দুটো আছে নাকি? না হয় সে একটু ছোট খাটই দেখতে। তাই বলে পিচ্চি বাবু নাম দিতে হবে নাকি। আর ‘ঢাকাইয়া কুট্টি’ কেন বলল?
বাবুরা মূলত পুরনো ঢাকার বাসিন্দা। ওর বাবা খাস ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বাবুরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। বাবুর আম্মার দেশ খুলনা। লেখাপড়া জানেন। শুদ্ধ কথা বলেন। ঐভাবে গড়ে তুলেছেন বাবুদের। মিঠুদের সঙ্গে দারুণ দহরম মহরম। আর শেলীদের সঙ্গে তেমন নয়। মনুর আচার আচরণের জন্যই বোধ হয় এই দূরত্বটা হয়ে যায়। তাছাড়া কবুতর পোষা নিয়ে একদিন শেলীর সঙ্গে বাবুর ঝগড়া লাগে।
বাবুর একজোড়া কবুতর তাড়িয়ে এনেছিল মনুর কবুতর। নিয়ম হচ্ছে কোন কবুতর জোট বেঁধে চলে এলে সে কবুতর তার হয়ে যায়। এমনভাবে মনুর একজোড়া কবুতর বাবু দখল করে নেয়। এমনকি শাহীনেরও একটা গিরিবাজ নিয়ে যায়। তখন কেউ তাকে বাধা দেয়নি। আর নিজের কবুতর যখন জোট বেঁধে চলে আসে তখন সে হন্যে হয়ে দৌড়ে কবুতর নিতে আসে। মনুভাই না থাকায় জোর করে নিজের কবুতর ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনার জন্য শেলী বাবুকে ‘চোর’ বলেছিল। সে থেকেই বাবু শেলীর ওপর রেগে আছে। বিটু আর বাবু যখন শেলীদের নিয়ে বিতর্ক করছে তখন এগিয়ে আসে মিঠু। খুব বিষণœ সুরে বলল-জানিস বাবু, শেলীরা না চলে যাচ্ছে।
: কোথায় যাচ্ছে।
: ওর আব্বা বদলি হয়েছেন।
: সত্যি বলছিস?
: ঐ দেখ না।
পেছনের দিকে তাকায় বাবু। একটা পাঁচ-টনি ট্রাক মাঠের এক প্রান্তে। মালপত্র ঠেসে ভরছে ওতে। মনুভাই আর তার আব্বা তদারকি করছে। গেটের সামনে লাল ঘাগরা আর ছাপা ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে শেলী। কিযে ফুটফুটে সুন্দর লাগছে ওকে! মিঠুরা এগিয়ে যেতেই মিষ্টি হাসল। বলল-বাবু ভাই, চলে যাচ্ছি, আপনাকে অনেক খারাপ বলেছি। মাফ করে দেবেন। বলেন; দেবেন না?
বাবু হকচকিয়ে যায়। এত সুন্দরভাবে কোনদিন কথা বলেনি শেলী। সব সময় তুই-মুই, পিচ্চি আর চোর বলে কথা বলেছে। কি একটা অনুভূতিতে বাবুর খুব কান্না পায়। সামলে নিয়ে বলে-শেলী আমি তোমাদের কবুতর দিয়ে দেবো। ওটা ডিম পেড়েছে। ক’দিন পর বাচ্চা ফুটবে। বাচ্চাসহ দিয়ে আসব। শেলী হাসল।
ট্রাক থেকে মনু চেঁচিয়ে ওঠে-“তাই নাকি বাবু? ওদের যত্ন করো কিন্তু। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব।” শেলী বলল- তোমরা কিন্তু অবশ্যই রায়ের বাজারে আসবে।” মিঠুরা ‘আচ্ছা’ বলল।
দুপুর নাগাদ ট্রাক ছেড়ে গেল। বত্রিশ নম্বর মানিক নগরের বাসা খালি হয়ে গেল। উদাস হয়ে গেলে সবার মন। সব চাইতে খারাপ লাগল মিঠুদের। বিটু-মিঠু একা হয়ে গেল। আবার কিছু দিনের জন্য একটা শূন্যতা ওদের গ্রাস করল।
ঘুরে ফিরে আসে শাহীনের কথা। দেখতে দেখতে মাস কেটে যায়। এরপর ঋতু। বছরটাও ছুঁবে হয়ত। সময়ের ফাঁকে ফাঁকে শাহীনের কবুতরগুলোও উড়ে যায়। ওরা হারিয়ে যায়। দূর নীলিমায়। যেমন করে ছেলেটা হারিয়ে যায়।
সমাপ্ত

Share.

মন্তব্য করুন