সর্বযুগের সকল মানুষের জন্য সর্বোত্তম চরিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা আমাদের প্রিয় নবীজি হজরত মুহাম্মাদ (সা)৷ শত্রু-মিত্র, ধনী-গরিব, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ এক কথায় সর্বশ্রেণীর মানুষ তার উত্তম চরিত্র ও আচার ব্যবহারে মুগ্ধ ছিল। কোরআন, হাদিস এবং ইতিহাসের পাতায় এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে রাসূলুল্লাহ (সা) এর উত্তম চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়ে ইরশাদ করেন, “আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা কালাম : ৪)
সাহাবীদের সাথে উত্তম আচরণ
রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়। তিনি কারো সাথে কখনো কঠোর ব্যবহার করেননি। তাই সাহাবীগণ রাসুলুল্লাহ (সা)কে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভে নিজেদেরকে ধন্য মনে করতেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় স্বভাবের ও কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।” (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)
শত্রুর সাথে উত্তম আচরণ
প্রাণ সংহারকারী শত্রুর প্রতিও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দয়া ছিল অপরিসীম। এ জন্য রাহমাতুললিল আলামিন রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার প্রাণের শত্রুকেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, তিনি নাজদ এলাকায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রত্যাবর্তন করলে তিনিও তার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করলেন। পথিমধ্যে কাঁটা গাছ ভরা এক উপত্যকায় মধ্যাহ্নের সময় তাঁদের ভীষণ গরম অনুভূত হলো। রাসূলুল্লাহ (সা) এখানেই অবতরণ করলেন। লোকজন ছায়াদার বৃক্ষের খোঁজে কাঁটাবনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা) একটি বাবলা গাছের নিচে অবস্থান করে তার তরবারিখানা গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। সবেমাত্র আমরা নিদ্রা গিয়েছি। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে ডাকতে লাগলেন। আমরা তাঁর কাছে উপস্থিত হলাম। তখন তাঁর কাছে এক বেদুইন বসা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমি নিদ্রিত ছিলাম, এমতাবস্থায় সে আমার তরবারিখানা হস্তগত করে কোষমুক্ত অবস্থায় তা আমার ওপর উঁচিয়ে ধরলে আমি জেগে যাই। তখন সে আমাকে বলল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? আমি বললাম, আল্লাহ! দেখ না, এ-ই তো সে বসে আছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে কোন প্রকার শাস্তি দিলেন না। (সহিহ বোখারি : ৪১৩৫)
দুধমাতার সাথে উত্তম আচরণ
পৃথিবীতে উত্তম ব্যবহারের সবচেয়ে বেশি হকদার হলেন মা। রাসূলুল্লাহ (সা) ছোট বয়সেই তাঁর মাকে হারান। তবে তিনি মাতৃতুল্য সকলকে মায়ের মত সম্মান করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তার দুধমাতা হালিমা (রা)-কে খুব সম্মান প্রদর্শন করতেন। এ ব্যাপারে একটি ঘটনার বর্ণনায় হজরত আবু তুফাইল (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আল-জি’ইরানা নামক স্থানে গোশত বণ্টন করতে দেখেছি। আবু তুফাইল (রা) বলেন, তখন আমি যুবক ছিলাম এবং উটের হাড় বহন করছিলাম। এ সময় এক মহিলা আসলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) ঐ মহিলার সামনে তার গায়ের চাদর বিছিয়ে দিলেন। তিনি তার ওপর বসলেন। আমি বললাম, ইনি কে? সাহাবীগণ বললেন, ইনি হলেন তাঁর দুধমাতা। (সহিহ মুসলিম : ৫১৪৪)
শিশুদের সাথে উত্তম আচরণ
রাসূলুল্লাহ (সা) শিশুদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই শিশুদেরকে কাছে পেলে কোলে নিয়ে আদর করে চুমু খেতেন। যারা শিশুদের আদর করা পছন্দ করত না তিনি তাদেরকে ভর্ৎসনা করতেন। এ সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা) বলেন, একদা এক বেদুইন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে এলো। সে দেখল রাসূলুল্লাহ (সা) শিশুদের চুমু দিয়ে আদর করছেন। তখন সে বলল, তোমরা কি শিশুদেরকে চুম্বন কর? আমরা তো শিশুদের চুম্বন করি না। তখন রাসূল (সা) বললেন, যদি আল্লাহ তা‘আলা তোমার অন্তর হতে স্নেহ-মমতা বের করে ফেলেন তবে আমি কি তা বাধা দিতে সক্ষম হবো? (সহিহ বোখারি ও মুসলিম, মিশকাত : ৪৯৪৮)
কোন শিশু রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কোলে পেশাব করলেও তিনি বিরক্তিবোধ করতেন না। বরং তার কাপড়ের ওপর পানি ছিটিয়ে তা পবিত্র করে নিতেন। এ ব্যাপারে উম্মে কায়স বিনতে মিহসান (রা) হতে বর্ণিত, তিনি তার একটি দুগ্ধপোষ্য ছোট ছেলেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) শিশুটিকে তাঁর কোলে বসালেন। তখন সে তাঁর কাপড়ে পেশাব করে দিল। তিনি পানি আনিয়ে এর ওপর ছিটিয়ে দিলেন এবং তা ধৌত করলেন না। (সহিহ বোখারি : ২২৩, সহিহ মুসলিম : ২৮৭)
মূর্খ বেদুইনের সাথে উত্তম আচরণ
মূর্খ বেদুইন সাহাবী যাদের আদব কায়দা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই তাদের সাথেও রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত কোমল আচরণ করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, একদা জনৈক বেদুইন মসজিদে দাঁড়িয়ে পেশাব করল। তখন লোকেরা তাকে পাকড়াও করতে গেলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের বললেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং পেশাবের ওপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে কোমল ও সুন্দর আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠোর আচরণ করার জন্য পাঠানো হয়নি। (সহিহ বোখারি : ২২০)
খাদেমের সাথে উত্তম আচরণ
আমরা অনেকেই কারণে-অকারণে সামান্য ত্রুটি পেলেই খাদেমদের সাথে বকাঝকা করি। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। হজরত আনাস (রা) বলেন, আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমাত করেছি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো আমাকে ‘উহ্’ শব্দও বলেননি এবং কোন সময় আমাকে এটা কেন করলে, ওটা কেন করনি তাও বলেননি। (সহিহ বোখারি : ৫৯০৫)
মুয়াজ্জিনের সাথে উত্তম আচরণ
মসজিদের মুয়াজ্জিন আজান দিতে সামান্য একটু দেরি করলেই বর্তমানে অনেক মসজিদে মুসল্লিরা তাদেরকে বিভিন্ন কটুকথা বলে। অথচ ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হজরত বিলাল (রা) নিদ্রার কারণে যথাসময়ে আজান দিতে না পারলেও রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে কোন কটুকথা বলেননি এবং তাকে কোন ধমকও দেননি। বরং শুধুমাত্র কারণ জানতে চেয়েছিলেন।
এ ঘটনার বর্ণনায় হজরত আবু কাতাদা (রা) বলেন, এক রাতে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। যাত্রী দলের কেউ কেউ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! রাতের এ শেষ প্রহরে আমাদের নিয়ে যদি একটু বিশ্রাম নিতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমার ভয় হচ্ছে সালাতের সময়ও তোমরা ঘুমিয়ে থাকবে। বিলাল (রা) বললেন, আমি আপনাদের জাগিয়ে দিব। কাজেই সবাই শুয়ে পড়লেন। এ দিকে বিলাল (রা) তার হাওদার গায়ে একটু হেলান দিয়ে বসলেন। এতে তাঁর দু’চোখ মুদে এলো। ফলে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সূর্য কেবল উঠতে শুরু করেছে, এমন সময় আল্লাহর রাসূল (সা) জাগ্রত হলেন এবং বিলাল (রা)-কে ডেকে বললেন, হে বিলাল! তোমার কথা গেলো কোথায়? বিলাল (রা) বললেন, আমার এতো অধিক ঘুম আর কখনও পায়নি। আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা করেছেন তখন তোমাদের রূহ কবজ করে নিয়েছেন; আবার যখন ইচ্ছা করেছেন তখন তা তোমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। হে বিলাল! উঠ, লোকদের জন্য সালাতের আজান দাও। অতঃপর তিনি অজু করলেন এবং সূর্য যখন ওপরে উঠল এবং উজ্জ্বল হলো তখন তিনি দাঁড়ালেন এবং সালাত আদায় করলেন। (সহিহ বোখারি : ৫৯৫)
মেহমানের সাথে উত্তম আচরণ
রাসূলুল্লাহ (সা) মেহমানদের অনেক সম্মান ও খাতির যতœ করতেন। হেরা পর্বতের গুহা থেকে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে আসার পর হজরত খাদিজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যেসব গুণাবলি উল্লেখ করে সান্ত¡না দিয়েছিলেন তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তিনি মেহমানদের সম্মান ও খাতির যতœ করতেন। যদি কখনো রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিজের ঘরে খাবার না থাকত তখন কোন সাহাবীর বাড়িতে মেহমানের মেহমানদারির ব্যবস্থা করতেন। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মেহমানদারি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেরা অভুক্ত থেকে হলেও মেহমানকে খাওয়াতেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খেদমতে এলো। তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে লোক পাঠালেন। তাঁরা জানালেন, আমাদের নিকট পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, কে আছ যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসেবে নিয়ে নিজের সাথে খাওয়াতে পার? তখন এক আনসারি সাহাবী বললেন, আমি প্রস্তুত আছি। এ কথা বলে তিনি মেহমানকে নিয়ে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মেহমানকে সম্মান কর। স্ত্রী বললেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া আমাদের ঘরে অন্য কিছুই নেই। আনসারি বললেন, তুমি আহার প্রস্তুত কর এবং বাতি জ্বালাও এবং বাচ্চারা খাবার চাইলে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সে বাতি জ্বালাল, বাচ্চাদেরকে ঘুম পাড়াল এবং সামান্য খাবার যা তৈরি ছিল তা উপস্থিত করল। বাতি ঠিক করার বাহানা করে স্ত্রী উঠে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিলেন। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই অন্ধকারের মধ্যে আহার করার মত শব্দ করতে লাগলেন এবং মেহমানকে বুঝাতে লাগলেন যে, তারাও সঙ্গে খাচ্ছেন। তাঁরা উভয়েই সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় কাটালেন। ভোরে যখন তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গেলেন, তখন তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাদের গত রাতের কান্ড দেখে খুশি হয়েছেন এবং এ আয়াত নাজিল করেছেন। তারা অভাবগ্রস্ত সত্ত্বেও নিজেদের ওপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়। আর যাদেরকে অন্তরের কৃপণতা হতে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলতাপ্রাপ্ত। (সূরা হাশর : ৯) (সহিহ বোখারি : ৩৭৯৮)

 

Share.

মন্তব্য করুন