পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রাণী প্রজাতি রয়েছে। এদের অধিকাংশ প্রাণীরই রয়েছে বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়, নিরাপদ বাসা। নিরাপদ ঘরবাড়ি। যেখানে তারা প্রকৃতির নানা প্রতিকূল অবস্থা যেমন ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, রোদ, ঠা-া, গরম ও শত্রুর আক্রমণসহ নানা প্রকার বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পায়। উন্নত প্রাণী নানা প্রজাতির রঙবেরঙের নান্দনিক পাখিও এ স্বভাবের বাইরে নয়। তাদেরও রয়েছে বসবাসের জন্য বিভিন্ন ধরনের বাসা। এ বাসাতে এরা বিশ্রাম নেয়, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফুটিয়ে নিজের বংশ টিকিয়ে রাখে। নিজেদের পরিবারকে নানা প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে। ডিম, বাচ্চার যতœ নেয়। শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করে। বাবা মা দু’জনেই অথবা একজনেই এ বাসা বহু কষ্টে তৈরি করে এবং পরে আরামে বসবাস করে। তবে বাসা তৈরির সময়টা এদের প্রজনন কালেই বেশি চোখে পড়ে। এ সময় এরা বাসা বানিয়ে তাতে ডিম পাড়ে। ডিমের যতœ নেয়, তা দেয়। বাচ্চা ফুটে গেলে বাচ্চার যতœ নিয়ে পরম মমতায় বড় করে। তারপর বাচ্চারা বাসা থেকে উড়ে যায় এবং নিজের মত চলাফেরা করে।
বাসা তৈরিতে আমাদের মতই পাখিদের আনন্দ হয়। তারা আনন্দে গান করে। আবার নিজেদের ডিম ও তা থেকে বাচ্চা এলেও আনন্দ প্রকাশ করে নানা ভঙ্গিতে। নাচে, গান করে, ওড়াউড়ি করে। এগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছাড়া উপলব্ধি করা যায় না। পাখিদের অধিকাংশ বাসাই শিল্পে পরিপূর্ণ। শিল্পে ঠাসা। দেখলে সৃষ্টিকর্তার কথা যে কারো মনে হবে। হওয়ার কথা।
যাহোক আগামীর পাখি পর্যবেক্ষক বন্ধুরা, আর বিলম্ব না করে কয়েকটি সুন্দর পাখির বাসা স¤পর্কে তোমাদের কিছুটা জানিয়ে দেই।

বাবুই
শিল্পী এই পাখিটি বাসা বাঁধে খুবই নিরিবিলি নিবিড় শান্ত পরিবেশে। গ্রামগঞ্জের তালগাছ, সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ, খেজুর গাছ বা আখের ক্ষেতে বাসা বানাতে সব চাইতে বেশি পছন্দ করে। হিজল গাছে বাসা বানানোর বিষয়টা চোখে পড়ে। বাসাটিতে শিল্পের এত কারুকাজ দেখার মত, না দেখলে বোঝা যায় না। এত সুন্দর, আকর্ষণীয় ও শিল্পে মজবুত বাসা খুব কম পাখিই বানাতে পারে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ধানের পাতা, খড়ের ফালি, তালের কচিপাতা, কাশবনের লতা, ইত্যাদি ব্যবহার করে। অসম্ভব সুন্দর এই বাসা। তালগাছ বা সুপারি গাছের ডালে এমনভাবে শক্ত করে আটকানো থাকে যাতে ঝড় বাতাসে ছিঁড়ে না যায়। এদের বাসা দেখলে যে কেউ সাহসী হয়ে ওঠে। স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, কর্মঠ হয়ে। ওঠে এরা ঠোঁট দিয়ে আস্তর ছড়ায়। মসৃণ করে পেট দিয়ে ঘসে। দুটি নিম্নমুখী গর্ত করে থাকে বাসা বানানোর শুরুতে। একদিকে বন্ধ করে পরে ডিম পাড়ার স্থান করে। আরেক দিকে লম্বা করে আসা যাওয়ার পথ তৈরি করে। ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বাসার ভেতরে কাদার প্রলেপ দেয়। আর দোলনায় দোল খাওয়ার মত বাসাও এরা তৈরি করে। বাসায় মাঝখানে থাকে আড়া। যেখানে পাশাপাশি কাছাকাছি বসতে পারে বাবুইরা। এখানে এরা ঘুমায়। বাসাটি শেষ করতে ৬-১০ দিন সময় লাগে। একটি মজার ঘটনা হলো রাতে বাসার ভেতর চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মত আলোকিত করতে রাতে জোনাকি ধরে আনে। সারারাত বাসায় আটকে রাখে। সকালে ছেড়ে দেয় জোনাকিকে।

টুনটুনি
টুনটুনি পাখি মাটি থেকে একটুখানি উঁচুতে বাসা বানায়। বাসা বানানোর জন্য টুনটুনি পাখি বিভিন্ন জঙ্গলে তথা ঝোপঝাড়কে বেছে নেয়। তবে ঝোপঝাড়ের বড় বড় পাতার গাছকেই বেশি পছন্দ করে নিজেদের বাসা বানানোর জন্য। যেমন গুড়ি কচু, কুমড়ো, লাউ, শিম, ডুমুর, বাতাবিলেবু ইত্যাদি প্রশস্ত পাতা যুক্ত গাছে এরা বাসা বাঁধে। দু’জনেই বাসার জায়গা নির্বাচন ও বাসা তৈরি করে। এক একটি পাতাকে টেনে নিয়ে সেলাই করে বাসা মোড়কের মত করে। বাসা করতে ৪-১০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এতে উপকরণ সংগ্রহ করতে শত শতবার এদের যাতায়াত করতে হয়। এদের বাসা লম্বাটে। উপকরণগুলো হলো, শুকনো ঘাস, তুলো, কাপড়ের টুকরো, পাটের আঁশ, মাকড়সার জাল, সরু লতা, পালক ইত্যাদি।

দোয়েল
দোয়েল পাখি, অন্য পাখিদের বাসা দখলের ক্ষেত্রে এ বাংলাদেশে প্রথম বলতে হবে। এরা আবাবিল, কাঠঠোকরা, টিয়া, বসন্তবৌরি ইত্যাদি পাখির বাসা দখল করে বাস করে। আবার নিজেরাও বাসা বানায়। বাসা বানানোর ক্ষেত্রে বোকামি করে। মানুষ চলাচল করে এমন জায়গায় বা বন্য প্রাণীর নাগালেই বাসা করে ফেলে। এরা বাঁশের মাথার গর্তে, সুপারি গাছের গর্তেও বাসা করে। তা ছাড়া দালানের ফাঁকফোকরে, গাছের কোটরে, ফেলে দেয়া হাঁড়ি কলসির ভেতরও বাসা করে। এদের বাসাটি বাটির মত। আবার চায়ের কাপের মতও হতে পারে। বাসার উপকরণ টুনটুনিদের মতই।
শালিক
গো-শালিক বাসা করে টেলিগ্রাফ বা ইলেকট্রিক খামের তারের ওপর, গোবরে শালিক মসজিদের মাইক বক্সে বাসা বাঁধে। গো-শালিক বাদে অন্যারা দালানের ফাঁকফোকরে, গাছের কোঠরে, ভেন্টিলেটারে, হাঁড়ি, কলসির ভেতরেও বাসা বাঁধে। বাসার উপকরণ বেশি থাকে। গো-শালিকের বাসার উপকরণ নিচের দিকে অনেকখানি ঝুলে থাকে।

বুলবুল
বাসা বাঁধে পছন্দমত যে কোনো জায়গায়। বাসার আকৃতি পেয়ালার মত। বাসা বানাতে সময় লাগে ২-৫ দিন। উপকরণ সব বাসার প্রায় একই রকম। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ছোট ঝোপঝাড়ে বাসা বানায়। এ ছাড়া গাছের গতর্, ঝাপালো গাছ, ভাসমান কচুরিপানা, নদীতীরে গর্ত, বাসা বাড়ির কার্নিশ ইত্যাদিতে বাসা বানায়। ভূমি থেকে বাসার উচ্চতা থাকে ৭-১০ ফুট। ডাল, ধাতব তার, পাতা, কঞ্চি, ঘাস, চুল ইত্যাদি মাকড়সার জালে জড়িয়ে পরিপাটি করে বাটির মত বাসা বানায়। বাসা বানানো হয়ে গেলে তিনটি ডিম পাড়ে তাতে।

ডাহুক
ডাহুক বাসা বানায় সাধারণত বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত পানির আশপাশের ঝোপঝাড় কিংবা বেতঝাড়ের ভেতর, কলমিঝোপে ও কচুরিপানার ওপর ডাহুকেরা বাসা বানায়। আবার যদি কোনো প্রকার ঝুঁকি না থাকে তাহলে মাটিতেও এরা বাসা বানায়। এদের বাসা বাটির মত গোল। অনেক সময় খেলার বলের মত গোল। এদের বাসা হয় বেশ বড়। বাসা গোছালো নয়। বাসার উপকরণগুলো হলো শুকনো পাতা, বাঁশের শিকড় ও পাতা। কচুরিপানার শিকড়, পাটের আঁশ শেওলা, পানির ঘাস ইত্যাদি। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রজননের সময় এরা ৬-৭টি ডিম দেয়।

ডাহুক
কাক
বছরের যে কোন সময় এরা বাসা করে লম্বা তালগাছসহ অন্যান্য লম্বা গাছে। গাছ-গাছালির শুকনো ডালপালাই হচ্ছে এদের বাসার উপকরণ। বাসা বানাতে সময় লাগে ৬৯ দিন। সাধারণত লোকজন থেকে দূরে এরা বাসা বানায়। কাকসহ শিকারি পাখিদের বাসাগুলো উঁচুতে কওে, বড়সড় হয় এবং অগোছানো হয়।
হলদে পাখি
হলদে পাখিরা বাসা বাঁধে বিভিন্ন গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের আম গাছের ভেতর। বাসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে প্রধানত বিভিন্ন গাছের শুকনো পাতা। এছাড়া থাকে বিভিন্ন খড়কুটো, আঁশ, পালক, শুকনো সরু লতা ইত্যাদি উপকরণ। এরা আম গাছসহ অন্যান্য গাছের শক্ত ডালের সাথে বাসাটি আটকিয়ে রাখে

ঘুঘু
বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ ও নিচু ঝোপঝাড়ে বাসা বানায় ওরা। বাসা সাধারণত লোকালয় থেকে দূরে করে। কারণ এরা ছিমছাম পরিবেশে লোকজনের কোলাহল থেকে আড়ালে থাকতে ভালোবাসে। শুকনো লতাপাতা, খড়সহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা দিয়ে এরা বাসা বানায়। অন্য পাখির মত এরা বাসা বানাতে হালকা ও নরম আঁশের মত কুটো ব্যবহার করে না। এরা শক্ত ও চিকন গাছের আঁশ ও পাতার বোঁটা ব্যবহার করে। বাসাটি অনেকখানি অগোছালো হয়। তবে ঝুট ঝামেলা না থাকলে এরা মাটিতেও বাসা বানায়। তবে মানুষের চোখ যদি ঘুঘুর বাসা দেখে ফেলে তবে ঘুঘু পাখি এটা টের পেয়ে যায়। আর তখন নিরাপদে বাসাটি সরিয়ে ফেলে।

টিয়া
টিয়া পাখিরা গাছের কা-ে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এদের বাসা উঁচুতে হয় ও ভেতরে জায়গা প্রশস্ত হতে হয়। মুখ বড় হয়। এরা শিমুল গাছের নরম কা-ে গর্ত করে বাসা বানাতে বেশি পছন্দ করে। শিমুলের কাঁটা তাদের ডিম ও বাচ্চার আত্মরক্ষায় সহযোগিতা করে
ফুলঝুরি
বাংলাদেশের সবচাইতে ছোট এই পাখিটি শক্ত ডালে বাসা করে। সাধারণত একটু ঘন গাছপালা ও বুনো এলাকায় বাসা বানায়। বাসা হয় খুব ছোট। মাটি থেকে ৫-১০ মিটার উঁচু কোন সরু ডালে গোপনে বাসা তৈরি করে স্ত্রী পাখি। ৩-৫ দিন সময় লাগে বাসা বুনতে। বাসাটি থলের মত ঝুলন্ত লম্বাটে। এদের বাসার প্রবেশ করার দরজার উপর কোন ঢাকনা থাকে না। বাসার উপকরণ হলো নরম সরু খাস বিভিন্ন সরুলতা মাকড়সার জাল ইত্য্যদি উল্লেখযোগ্য।

মাছরাঙা
মাছরাঙারা ডোবা নালা ও খালের পাড়ের দেয়াল ও নদীর পাড়ে বাসা করে। আবার পাহাড় টিলার গায়েও গর্ত করে বাসা করে। পা ও ঠোঁট দিয়ে গর্ত বানায়। গর্তের গভীরতা অনেক বেশি থাকে। এরা কোনো উপকরণ ব্যবহার করে না। তবে ছানাদের খাওয়াতে যেয়ে অনেক মাছের আঁইশ জড়ো হয়। সেগুলো দিয়েই বাচ্চা মাছরাঙারা বিছানা করে। এরা গর্তটি ঠিক এমন জায়গায় করে যেখানে সাপ কিংবা গুইসাপ উঠতে পারে না। আবার গর্তের গভীরতা বেশি থাকায় শিকারি বা মাংসাশী প্রাণীরাও কোনো অকল্যাণ করতে পারে না। এদের বাসা বানাতে ৪-৫ দিন সময় লাগে।

ময়না
এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে বিভিন্ন বন অথবা চা বাগানের কাছাকাছি ১০-১৫ মিটার উঁচুতে গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। তবে এদের গর্ত বা কোটর এরা করে না। এটি কাঠঠোকরা পাখি করে। সেই কোটরে এরা ঘাস পালক ও আবর্জনা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
ময়না পাখির বাসা

শিশু-কিশোর বন্ধুরা! তোমরা মাত্র কয়েকটি পাখির বাসা স¤পর্কে কিছুটা জানতে পেরেছ আশা করছি। তবে তোমাদের মন নানা কৌতূহলে ভরা। তোমাদের অনেকের পাখির বাসা খোঁজার নেশা আছে। আছে নিজের অজান্তেই পাখির ডিম বা ফুটফুটে বাচ্চা বাসা থেকে নিয়ে আসার অভ্যাস। হয়তো কারো কারো অভ্যাস থাকতে পারে বাসাটি নিয়ে আসা অথবা ভেঙে ফেলার। বাবুই পাখির বাসাতো তোমাদের মত শিশু-কিশোরদের হাতে কত দেখেছি আমি। এগুলোর অভ্যাস থাকলে কখনই আর করবে না। এতে করে ওদের মা-বাবারা ভীষণ কষ্ট পায়। কমতে থাকে পাখির সংখ্যা, যাতে করে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে। এসব পাখি শত রকম ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে ফসলের বাম্পর ফলনে সহায়তা করে। তা ছাড়া তাদের গান, কলকাকলি কলরব কার না ভালো লাগে? তাই নৈসর্গিক পরিবেশের জন্য এবং আমাদের দেহমন ভালোভাবে বিকাশের জন্য পাখিদের প্রয়োজন অপরিসীম। তা ছাড়া পাখির গান, পাখির নাচ, মিষ্টিসুর, কলকাকলি কলবর, আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো ও পাখির বাসা নানা সাহিত্য সৃষ্টিকে ও শিল্প সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে। আমাদের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। স্বনির্ভর করে।
ছোট বন্ধুরা! আজ আর নয়। পরিশেষে তোমারে জন্য একটি ছড়া লিখে শেষ করছি আজকের লেখাটি।

তালের গাছের মাথার ওপর বাবুই পাখির বাসা
এই বাসাতে বাবুই পাখির শিল্প ঠাসা ঠাসা।
এই বাসাটা কেউ কখনো নেবে না
যেই চাক না কাউকে কভু দেবে না।
তবেই বাবুই এই বাসাতে করবে যাওয়া আসা।

 

Share.

মন্তব্য করুন