নানুর বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া হয় মুমতাহার। নানুবাড়ি যাওয়াটা ওর কাছে অনেক আনন্দের। আনন্দের না হয়ে মন খারাপের হবেই বা কেন? সেখানে কি মন খারাপ হওয়ার কোনো ফুরসত আছে? ফাইজা, আফরীন আর তন্নী আছেনা? চার বান্ধবী মিলে জম্পেশ মজা করা যায় নানুবাড়ি গেলে। মুমতাহার তো ইচ্ছে করে যেন ওখানে থেকেই যায়। কিন্তু আব্বু আম্মু থাকতে দেয় না। বাড়িতে এসে নাকি স্কুলে যেতে হবে, কোচিং করতে হবে। এতো কি আর ভালো লাগে! ওর তিন বান্ধবী তো ওখানেই পড়ালেখা করে। একবার আম্মুকে আবদার করে বলেছিলো, ‘আম্মু, ফাইজা, আফরীনদের মতো আমাকেও ওখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও। আমি সেখান থেকে পড়াশোনা করবো।’ কিন্তু সেই বলাই ছিলো শেষ বলা। আম্মু এতো কড়া ধমক দিয়েছিলো যে ও পরেরবার আর কিছু বলার সাহস পায়নি। আম্মু বলেছিলো, ‘সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলে তো পড়ার নামটাও মুখে নেবে না। দিনরাত শুধু খেলা খেলা করবে।’ আম্মু ঠিকই বলেছে। নানুর বাড়িতে গেলে ওর তিনটে বান্ধবী ছাড়া আর কিছুই বোঝে না মেয়েটা।
মুমতাহা যখন কয়েকদিন নানুবাড়িতে থেকে বাসায় ফেরত আসে, তখন ওর খুব মন খারাপ হয়। আর কটা দিন থেকে গেলে কি হতো? তন্নী যে ওকে একটা ভূতের ছানা দেখাতে চেয়েছিল!
‘জানিস মুমতাহা, আমরা তিনজনে মিলে একটা ভূতের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভূতের বাড়িতে অনেকগুলো ভূতের ছানা আছে। তার মধ্যে একটা দেখতে খুব কিউট আর খুব বদমাইশ। সেদিন তো ফাইজার বেণি ধরে দিলো টান। হাহাহা।’ বলেই খিলখিল করে হাসতে ধরেছিল তন্নী। সেসব কথা মনে করে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় ওর। ইশ! কেন যে আম্মুটা আর দুটো দিন থাকলো না! ভূতের বাড়ি আর ওই কিউট ভূতছানাকে ঘিরে কৌতূহল বাড়তে থাকে মুমতাহার। এসব ভাবতে ভাবতেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম ভাঙে। ৭টা বেজে গেছে। ৮টায় স্কুল। তাড়াতাড়ি করে স্কুলে যাবার জন্য রেডি হতে লাগলো মুমতাহা। বাথরুম থেকে ফিরে ড্রেস হাতে নিয়েছে, এমন সময় আম্মু বললো, ‘আজ স্কুলে যেতে হবে না।’ মুমতাহা কিছুটা ভয় পেল। সে উল্টোপাল্টা কেনোকিছু করে বসেনিতো! তাহলে কেন আম্মু স্কুলে যেতে না করছে? আম্মু আবার বললো, ‘নতুন কাপড়গুলো পরো। তোমার নানুবাড়ি যাবো।’ মুমতাহা আম্মুর কথা হঠাৎ করে বুঝতে পারলো না। যখন বুঝতে পারলো যে আম্মু আজ নানুবাড়ি যাবে, সাথে সেও যাবে, তখন ইচ্ছে হচ্ছিলো দে এক লাফ। কিন্তু আম্মুর সামনে নিজেকে সংবরণ করে গলায় একটু থমথমে আওয়াজ টেনে বললো, ‘কেন আম্মু? হঠাৎ নানুর বাসায় যাচ্ছো কেন?’ আম্মুর কাছে মুমতাহার অভিনয় টিকলো না। বললো, ‘অতো ঢং করতে হবে না। যাও রেডি হয়ে আসো। তোমার নানু এবার কুরবানিতে বিরাট বড় একটা গরু কিনেছে। পাড়াসুদ্ধ সব লোক নাকি দেখতে আসছে। আমরাই বা আর বাদ পড়বো কেন? তাই ভাবলাম, গিয়ে দেখে আসি। আজ গিয়ে কালই চলে আসবো। তোমার আবার স্কুল আছে।’ মুমতাহার যেমন মন ভালো হয়েছিল তেমনি আবার মন খারাপও হলো। মাত্র একদিন! তাহলে তো কেনোকিছুই ভালোভাবে হবে না। তবুও ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো’ প্রবাদে নিজেকে সন্তুষ্ট করে রেডি হতে যায় মুমতাহা।
প্রায় সময় ট্রেনেই যাওয়া হয় নানুবাড়ি। আজকে একটুর জন্য ট্রেন মিস করায় বাসে করে যেতে হচ্ছে। আব্বুর অফিসে মিটিং থাকায় আসতে পারলো না। মুমতাহা বরাবরের মতোই বাসে জানালার পাশে বসে। নানুবাড়ি যাবার আনন্দ যেন ওর বুকে আর ধরে না। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। হাওয়ায় ওড়ে ওর ছোট ছোট সিল্কি চুল। বাইরের মাঠঘাট দেখতে দেখতে ভাবে, আজ যে করেই হোক ফাইজা, তন্নী আর আফরীনকে সঙ্গে নিয়ে ভূতের বাড়িতে যেতে হবে। পিচ্চি ভূতের কারসাজি দেখার উত্তেজনা যেন তার শেষ হয় না। আম্মু তো আগেই বলে দিয়েছে, কালই চলে আসবে। সুতরাং আজকেই শেষ সময়।
নানুবাড়িতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে তাদের বিকাল লেগে যায়। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জার্নি করে আম্মু আর মুমতাহা দু’জনেই এখন ক্লান্ত। নানুর কেনা বিশাল গরুটাকে দেখে, নাদুসনুদুস গরুটার প্রশংসা করে আম্মু গেলো রেস্ট করতে। মুমতাহাকে তার সাথে শুতে বললে ও বললো, ‘আম্মু, আমি গরুটাকে আরেকটু দেখি তারপর শুতে যাবো।’ আম্মু ওকে অনুমতি দিলো। আবার সাবধানও করে দিলো যাতে কোথাও না যায়।
কিন্তু মুমতাহার মনে তো অন্য ফন্দি। আম্মু শুয়ে পড়তেই ও দৌড় দিলো তন্নীর বাড়ি। তন্নীকে ডেকে বাকি দু’জন বান্ধবীর বাড়িতে গেলো তাদের ডাকতে। সবাইকে ডেকে এনে একসাথে মিলিত হলো চার বান্ধবী। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। মুমতাহার নানুবাড়ির চারপাশজুড়ে জঙ্গল, সন্ধ্যা পড়তে না পড়তেই অন্ধকার নেমে আসে। কিন্তু চার খুদে বান্ধবীর সেদিকে খেয়াল নেই। তারা ভূতের বাড়িতে যাবার জন্য ব্যস্ত। ঠিক সেভাবেই প্ল্যান তৈরি করে ফেললো তারা। যেহেতু আগেরবার মুমতাহার অনুপস্থিতিতে ওরা তিনজনই কেবল গিয়েছিলো, সেহেতু মুমতাহা ঠিক করলো এবারে দলনেত্রী হবে সে। তার পিছে পিছে আসবে বাকিরা। এটা ওর দাবি। আফরীন একটু অন্য সুর করে বললো, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেলো রে। এখন যাবি? যদি ভূত ঘাড় মটকে দেয়?’ তন্নী এক ধমকে থামিয়ে দিলো আফরীনকে, ‘দুর তুই চুপ কর তো। যে না পুচকি কটা ভূত, তাদের আবার ঘাড় মটকানো! বোতলে পুরে নিয়ে আসবো সবকটাকে এবার দেখিস। সেবার ফাইজার চুলের বেণি ধরে টেনেছিলো না? ওইযে বদমাইশ পুচকে ভূতটা? ওকে তো বোতলে পুরবোই। তারপর সবাই মিলে ভূত পোষবো। মানুষ বিড়াল, কুকুর পোষে। আমরা পোষবো ভূত। হাহাহা।’ ফাইজা বলে, ‘এহ দেমাগ কত। দেখা যাবে কে কাকে পোষে। এখন চল।’ সবাই ভূতবাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়।
মুমতাহা বড় বড় কথা বললেও ওর কিছুটা ভয় করতে থাকে। কিন্তু দলনেত্রী হয়ে ভয় করলে তো মানায় না। সে হাঁটতে থাকে কোনোরকম সংকোচ না করে। তন্নী তার পাশাপাশি হাঁটে, রাস্তা দেখায়। কেননা মুমতাহা এর আগে যায়নি বলে রাস্তা চেনে না। পেছন থেকে ফাইজা ভেংচি কেটে বলে, ‘রাস্তা চেনে না আবার দলনেত্রী!’ মুমতাহা সেদিকে কান দেয় না। সন্ধ্যা গড়িয়ে তখন রাত ঘনিয়ে আসছে। টর্চ মেরে রাস্তা দেখে ওরা।
দশ মিনিটের মধ্যে অনেক বছরের পুরনো, পরিত্যক্ত একটা বাড়িতে এসে পৌঁছে। ভাঙা জানালা, দরজা নেই, দোতলা বাড়িটার দেয়ালগুলো শ্যাওলায় ভরে কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। জায়গাটা এতো অন্ধকার যে টর্চ লাইটও ভালোভাবে কাজ করে না। আফরীন বললো, ‘চল যাওয়া যাক। দেখি তোদের কেমন বুকের পাটা।’ মুমতাহার যেতে ইচ্ছে করছিলো না বাড়িটা দেখে। বইয়ে পড়া ভূতের গল্পগুলো মতো মনে হয়। যেন সে-ই এখন গল্পের মূল চরিত্র।
টর্চ হাতে ওরা সবাই খোলা ঘরে ঢুকে। মুমতাহার হাত ভয়ে মৃদু কাঁপছে। ফাইজা বললো, ‘কিরে চল। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দোতলায় উঠতে হবে। ওখানে ভূতের ছানাগুলো আছে।’ আফরীন বুঝতে পারে যে মুমতাহার ভয় করছে। তা ছাড়া এমন জায়গায় ও আগে কখনো আসেনি। ওরা তিনজন আগে এসেছিলো বলে ওদের তেমন ভয় করছিলো না। তিন বান্ধবীর জোরাজুরিতে মুমতাহাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোতলায় উঠতে হলো। সে এখন আর দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছে না। ভয়ে একদম আড়ষ্ট হয়ে গেছে। ওর জায়গা নিলো তন্নী। মুমতাহার হাত থেকে লাইটটা নিয়ে বললো, ‘আয় আমার সাথে।’
দোতলায় উঠতে গিয়ে মুমতাহা লক্ষ করলো, বাড়িটা যেমন পুরনো সিঁড়িগুলোও তেমন পুরনো। কাঠের সিঁড়ি সবগুলো। তারপরে আবার ভাঙা। একটার পর একটা সিঁড়ি বেয়ে খুব সাবধানে উঠতে লাগলো ওরা। মুমতাহা মনে মনে ভাবে, না জানি দোতলায় কী অপেক্ষা করছে তার জন্য! নিচতলায় দেখা দুটো মানুষের কঙ্কাল আর একটা ভাঙা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি দেখে ওর মনে ভয় জেগেছে। কাঠের সিঁড়ির উপর পা ফেলে ধীরে ধীরে কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই দোতলায় উঠে আসে। মুমতাহা চোখ প্রায় বন্ধই করে ফেলেছিলো ভয়ের তোড়ে। ফাইজার চিমটিতে চোখ খুললো। দেখেই মাথায় হাত! রেডিয়ামের মতো সবুজ রঙের অনেকগুলো পিচ্চি ভূতের ছানা সবাই একসাথে খেলছে। অদ্ভুত তাদের খেলার ধরন। মানুষের বাচ্চারা যেমন খেলে তেমন খেলা না। একদম ভিন্নধর্মী খেলা। মুমতাহা বুঝতে পারে না কী খেলা খেলছে ওরা। কিন্তু ওদের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সেটা অনেক মজার খেলা।
‘ওই দেখ, ওইযে বদমাইশ ভূতছানাটা।’ বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো তন্নী। মুমতাহা তাকালো সেদিকে। দেখল, অন্যান্য ভূতদের তুলনায় অনেক ছোট সেই ভূত; আর গায়ের সবুজ রঙের বিকিরণ যেন ঠিকরে পড়ছে। অনেক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ভূতের বাচ্চাটাকে। অনেক কিউট আর আদুরে। এসব দেখে মুমতাহার ভয় অজান্তেই হারিয়ে যায়। ভূতছানাটা দেখে যে সেদিনকার তিনজন মেয়ে আবার তাকে ক্ষেপাতে এসেছে। সেবার তো একজনের চুলের বেণি টেনে ধরেছিলো, এবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে দিতে হবে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে। পিচ্চি ভূতছানা দেখলো একটা নতুন মেয়ে এসেছে ওদের সাথে। এটা আবার কে!
ততক্ষণে চার বান্ধবী ভূতছানাটার কাছে এসে গেছে। তন্নী ভূতটার গাল টেনে বললো, ‘কিরে কিউট ভূত, কি খবর? তোকে বিরক্ত করার জন্য আরেকজনকে নিয়ে এসেছি। এবার চারজন মিলে তোকে ক্ষেপাবো।’ ভূতছানাটা তার গোল মুখে ভেংচি কেটে বললো, ‘দেখা যাবে কে কাকে ক্ষেপায়।’ মুুমতাহা ভূতছানাটাকে বললো, ‘আমার সাথে খেলবে?’ ভূতছানা কিছুটা সময় নিলো ভাবার। তারপর সম্মতি জানালে সবাই মিলে মজা করে খেলতে লাগলো। মুমতাহা ভূতছানাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই খেলা তোমরা কোথায় শিখলে? আমরা তো কখনও এরকম খেলা খেলিনি।’ ভূতছানা বললো, ‘আমার বাবার শেখানো খেলা এটা। সবাই বই পড়ার ভঙ্গিতে খেলবে। বই পড়তে পড়তে খেলা আবার খেলতে খেলতে বই পড়া। যেমন ধরো বইয়ে পড়া মুখস্থ করার সময় কোথাও কোনো খেলার নাম পেলে, ধরো লেখা আছে কানামাছির কথা। তখনি আমরা সবাই একযোগে কানামাছি খেলা শুরু করি। কিছুক্ষণ খেলে আবার পড়তে বসি। আবার কোনো পৃষ্ঠায় খেলার কথা থাকলে খেলি। পড়াশোনার সাথে খেলাও একসাথে হয়। আমরা একসাথে দুটো কাজ করি।’ মুমতাহা ওদের খেলা-পড়ার ধরন দেখে মজা পায়। ভালোই তো। আম্মুর কাছে আর খেলার জন্য বকা খেতে হবে না। আম্মু নিশ্চয়ই এই পদ্ধতিটা পছন্দ করবে।
মুমতাহার চোখ হঠাৎ করে ওর হাতঘড়িতে পড়ে। দেখে রাত ৮টা বেজে গেছে। সর্বনাশ! এখন কী হবে! আম্মু নিশ্চয়ই এতোক্ষণে জেগে গেছে আর তাকে খোঁজাখুঁজি করছে। মুমতাহা তন্নী, ফাইজা আর আফরীনকে বললো, ‘চল চল বাড়ি চল জলদি। ৮টা বেজে গেছে। বকা খেতে হবে আজ নিশ্চিত। আমাদের জন্য চিন্তা করছে মনে হয়।’ তন্নী বললো, ‘হ্যাঁ জলদি চল। অনেক রাত হয়ে গেছে।’ পিচ্চি ভূতছানাকে বিদায় দিয়ে চার বান্ধবী বাড়িতে ফিরে এলো। মুমতাহা আম্মুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো আম্মু এখনো শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। আহ্ বাঁচলো যেন।
পরদিন সকালে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে এলো মুমতাহা আর আম্মু। গত রাতের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো ওর। ভূতছানার সাথে তো ভালোভাবে কথাই বলা হলো না। ওরা আরো কি কি মজার খেলা খেলে সেসব তো জানা হলো না। খুব ভালো হতো যদি ভূতছানাটাকে সঙ্গে আনতে পারতো। কিন্তু ওরও যে বাবা-মা আছে, কিভাবে আসবে! মুমতাহার খুব ইচ্ছে করছিলো আরো কটা দিন থেকে যেতে। কিন্তু আম্মু একদমই থাকতে দিলো না। পরেরবার নানুর বাড়িতে গেলে পিচ্চি ভূতছানাটার সাথে অনেক মজা করে খেলা যাবে; ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলো, ওই ভূতছানাটার সাথে সে পড়া- খেলা খেলছে। পড়তে পড়তে খেলা আর খেলতে খেলতে পড়া। ঘুমের ঘোরে হাসতে লাগলো মুমতাহা।

 

 

Share.

মন্তব্য করুন