সপ্তাহ খানেক আগের কথা। রাতে খেয়ে আমি, নাহিদ আর সোহাগ পড়ছিলাম। যে যার প্রিয় বই নিয়ে। সারাদিন প্রচুর কষ্ট হয়েছে। হঠাৎ ছুটি পেয়ে অনেক ঘুরেছি। সাইকেল চালিয়েছি। ঘুম ঘুম ভাব সবার চোখে। তারপরেও কারো চোখে ঘুম নেই। কেন যেন ঘুম আসছিল না। তিনজন গল্প শুরু করলাম। যদি ঘুম আসে এই খেয়ালে। সোহাগ জগ হাতে পানি আনতে গেল। আমি আর নাহিদ প্ল্যান করলাম সোহাগ ফিরে আসতেই ভয় দেখাব ওকে। দরজার পাশ থেকে। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম আমরা। সোহাগ দরজা খুলতেই আমরা হা হা হো হো করে হেসে উঠি। ও কিছুটা ভয় পেলো। কিন্তু বিচলিত হলো না। আমরা হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। মেসে আসার সময় বিস্কুট এনেছিলাম। তাই খেয়ে পানি পান করলাম। নাহিদ বললো আমার কাছে একটা নতুন ভৌতিক বই আছে। চল পড়ি সবাই মিলে। অনেকদিন ধরে রুমে একসাথে গল্পের বই পড়া হয় না।
ওর কথায় আমরা দু’জন রাজি হয়ে গেলাম। খাটে গিয়ে বসলাম। বৃহস্পতিবার রাত। একটা মুড়িভর্তা পার্টি হলে মন্দ হয় না। পাশের রুমের একজনকে ডাকলাম। সে মুড়ি আনতে গেল। আমরা সবাই গোল হয়ে বসলাম। মুড়ি ঢালার জন্য খাটে পেপার বিছানো হলো। মুড়ির গন্ধ পেয়ে এর মধ্যে আবার কোত্থেকে আরও ক’জন হাজির। আজকের পার্টি জমবে ভালোই। বই পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। পড়ছে নাহিদ। জোরে জোরে। ভৌতিক গল্পে আমাদের ভয় লাগার বদলে চরম হাসি পাচ্ছিল। লেখকের কৌতুক স্টাইলের প্রথম পর্বে। গল্পের নাম অদ্ভুত ভূতের অদ্ভুত শহর। হ্যাঁ দ্বিতীয় পর্বে এসে কিছুটা ভয় ধরছে। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছি। মুড়িভর্তা তৈরি হওয়ায় গল্প বন্ধ হলো। সবাই খাচ্ছিলাম। বেশি খাবার প্রতিযোগিতায়।
গল্প-পাগল ছেলে নাহিদ। প্রচুর বই পড়ে। বই সংগ্রহে রাখে। আমাদের গল্প শোনায়। মাঝে মাঝে। আজ মুড়ি শেষে জুড়ে দিল বাস্তব গল্প। শুনেছে তার মামার থেকে। গল্পটা তার মামার কণ্ঠেই বলছে-
মাস পাঁচেক আগে ঘটে যাওয়া সিলেটের ঘটনা। যেখানে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু শামসুর বাড়ি। অনেক অনুরোধের পর সেদিন গিয়েছি তাদের বাড়ি। বাড়িতে ৫-৬ জন সদস্য ছাড়া কেউ থাকে না। অনেক নিরিবিলি ও সুন্দর একটি বাড়ি। শামসুর বাবা ওপর তলায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তবে এখানে বলে রাখি আমি সিলেটে একা যাইনি। আমিসহ ঢাকা থেকে চার বন্ধু যাই। সবাই কৌতূহলী ছিলাম। কেননা সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল। আর সিলেট দেশের এমন একটি জায়গা যেটি ভ্রমণবিলাসী সব মানুষকেই মোহিত করে।
শামসুদের বাড়ি থেকে চা বাগানের দূরত্ব ছিল কম। আনুমানিক ২০ মাইলের মতো। যাই হোক আমরা সেখানে গিয়ে খুশি। প্রায় সবাই সকাল বেলা চা বাগান দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। শুধু আমি বেরুলাম না। প্রচ- ঘুমের কারণে।
পরে জেনেছি ওরা আনুমানিক ঘন্টার মাঝেই চা বাগানে পৌঁছে। এপাশ-ওপাশ ঘুরতে লাগল। ছবি তুলল। যার যার মত। সেই চা বাগানের সবুজের সমারোহ সবাইকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যা বলে বুঝানো যাবে না। অনেক ঘোরাঘুরির পর ওরা দুপুরে চলে আসে। ততক্ষণে আমি উঠেছি। ফ্রেশ হয়েছি। খেয়ে-দেয়ে সামান্য রেস্ট নিই। তারপর আবার সবাই বেরিয়ে পড়ি। ছোটখাটো পাহাড় দেখার মকসুদে। অল্প সময়ে পৌঁছলাম পাহাড়ের কাছে। দেখলাম প্রাণ ভরে। পাহাড়ে ওঠা-নামা আর সারাদিন ঘোরাঘুরিতে একটু বেশিই ক্লান্ত হলাম। বাসায় এলাম। বিকালে আমি একাই বেরুলাম। শামসু অবশ্য আমাকে একা যেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি ওকে পাত্তা না দিয়ে সামনে পা বাড়াই।
চা বাগানে যতদূর চোখ যায় ততদূর পথ হাঁটতে লাগলাম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। এভাবে পথ চলতে চলতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসে আমি বুঝতেই পারিনি। তখন ফিরে যাবার চিন্তা করি ৷ কিন্তু হায় কপাল! রাস্তা ভুলে গেছি। চা বাগানের সবুজ অরণ্যে অনেকক্ষণ হাঁটার পরও ফেরার পথটি খুঁজে পেলাম না! তখন শামসুকে একটা কল করার চিন্তা করলাম। ভাগ্যটা এত খারাপ ছিল যে, মোবাইলে নেটওয়ার্ক ছিল না।
এদিকে দিনের আলোও শেষ হয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজানও দিয়ে দিল! এখন কী করি! আমার অনেক ভয় লাগতে শুরু করলো। চারদিক থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ও বন্য জীব-জন্তুর ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। তখন আমি আমার সাথে থাকা গ্যাস লাইটারের ছোট বাতি জ্বালিয়ে অজানা পথ চলতে শুরু করলাম। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে আসছে। আর এতটা ভয় পেয়েছি যে কাউকে চেঁচিয়ে ডাকবো সেটাও পারছিলাম না!
এমন সময় হঠাৎ দেখি দূরে কে জানি একজন দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সঙ্গে একটি বাচ্চাও ছিল। যাক মানুষ দেখে কিছুটা ভয় কমে গেল। তারপর কাছে গিয়ে দেখি একটি মহিলা আর ছয়-সাত বছরের একটি মেয়ে।
আমি মেয়েটিকে বললাম, কে তুমি? তোমার নাম কী?
মেয়েটি বললো, আমি রুকাইয়া আর ওর নাম রৌনক।
বাড়ি বহু দূরে!
আপাতত এই বাগানেই থাকি।
মানে! বাগানে কেউ থাকে? খুলে বল সব।
আপনি কই যাবেন স্যার? দ্রুত চলে যান। সোজা পথ ধরে। আমাদের কেউ দেখে ফেলতে পারে। দেখলে ভারী বিপদ হবে।
রৌনকও বললো, হ্যাঁ স্যার ঐ পথে চলে যান।
কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম।
কিছুদূর এগুতেই গার্ডের দেখা। সিলেটি ভাষায় কিসব বলল। তার কথার মর্ম এই রকম- স্যার এত দেরি কেন? আরও মানুষের আওয়াজ শুনলাম। মহিলা কণ্ঠের! ওরা কারা? কই গেল? আমি বললাম, না তেমন কেউ নেই। আমি পথ ভুলে যাওয়ায় দেরি হয়েছে। তারপর সে একটা মুচকি হাসি দিয়ে দৌড়ে কোথায় জানি অদৃশ্য হয়ে গেল!
আমি অবাক হয়ে ক্ষাণিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম! তারপর বাড়ি চলে এলাম। আসার পর শামসুকে বললাম চা বাগানে কেউ কি থাকে? সে বলল, না। আমি বললাম, কেন এক মহিলাকে যে দেখলাম! ছোট একটি মেয়েও সঙ্গে ছিল। আর সেই তো আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে! শামসু স্পষ্ট বলল, ওখানে ক’জন গার্ড ছাড়া কেউ থাকে না!
আমি কিছুটা ভয় পেলাম। কাদেরকে দেখেছি আমি? ওরা মানুষ না অন্য কিছু! ব্যাপারটা সবাইকে জানালাম। ফাও আলোচনা হলো অনেক। পরের দিন বিকালে সবাই গিয়ে খুঁজলাম। শামসু নেতৃত্ব দিল। কোথাও কাউকে পেলাম না। বাধ্য হয়ে শেষে বুড়ো এক গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম। প্রথমে কিছু বললো না সে। ১০০ টাকার নোট এগিয়ে দিতেই মুখ খুললো। বলল, রোহিঙ্গা মুসলিমরা ইতিহাসের সবচে বড় নির্যাতিত। ওদের মাঝে যারা এদেশে ঢুকছে তাদের ফেরত পাঠাচ্ছেন প্রশাসন। যদি কেউ কোন রকম ওদের নজর এড়িয়ে দেশে থাকছে তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। থাকা খাওয়া থেকে শুরু করে সর্বদিকে কষ্ট পাচ্ছে। ক’জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। আমি ছাড়া অন্য গার্ডরা পর্যন্ত জানতো না। আমার অবর্তমানে হঠাৎ কাল ওদের দেখে ফেলে একজন। কর্তৃপক্ষকে জানায় সে। কর্তৃপক্ষ পুলিশের মাধ্যমে থানায় চালান করে। তার কথা শুনে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। কেন যে কাল ওদের জীবন সম্পর্কে খোঁজ না নিলাম। কেন যে কোন নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা না করলাম। কাল কেন এসব মাথায় আসেনি! কেন? কেন? কেন? রাগে-ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে আমার। পরে সবার পরামর্শে আমরা থানায় গেলাম। চেষ্টা চালালাম মুক্ত করতে। কিন্তু পারলাম না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। ওদের উদ্ধার করতে না পারার কষ্টে নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরোয়-আহ! রোহিঙ্গা মুসলমান! নিজের দেশে ওদের ঠাঁই নেই। কী দুর্বিষহ ওদের জীবন!