আফীফ হাসান একজন বিলাসবহুল মানুষ। বিলাসবহুল মানুষের অনেকগুলো শখ থাকে। শখের বশে তারা অনেক কিছুই করে। আফীফের একটি শখ হলো পাখিপোষা। বলা যায় এটা তার জন্মগত শখ। জন্মগত কোনো কিছু খুব সহজে দূর হয় না। আফীফের বেলাও ব্যতিক্রম নয়। ছোটবেলা থেকেই আফীফের পাখির প্রতি ছিল এক নিবিড় টান। সেই টান আজও বিদ্যমান। তাই এই প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছেও তিনি পাখি পুষছেন!

দুই.
ময়না পাখিটির বয়স তিন বছর। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তিন বছরের একজন মানবসন্তানের মতোই সে কথা বলতে শিখেছে!
ক্ষুধা পেলে দিব্যি দুধ, দুধ করে। মেহমান এলে বলে ওঠে, পিঁড়ি দে, পিঁড়ি দে! আর আফীফ চোখের আড়াল হলেই আপিহ কোই, আপিহ কোই।
পাখি তো আর পুরোপুরি উচ্চারণ করতে পারে না, তাই আফীফের নাম আপিহ, আপিহ উদগিরণ করে।
ময়না পাখিটি যখন এসব কথা বলে তখন আফীফের আনন্দ ধরে না! তিন বছরে এই পাখিটির প্রতি তার এমন প্রীতি সঞ্চয় হলো যা রীতিমতো অবিচ্ছেদ্য। তিনি নিজে খাওয়ার আগে পাখিকে খাওয়ান। নিজে গোসলের পূর্বে গোসল করান। তা ছাড়া সব কাজেই প্রথমে পাখির চাহিদা আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। এভাবে একসময় পাখির সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে! পাখিটি যেন তার একাকিত্বের একান্ত সঙ্গী!

তিন.
প্রতিরাতের মতো আজও আফীফ ঘুমুতে গেলেন। ঘুমিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন। অদ্ভুত স্বপ্নগুলো সবাই ঘুমিয়েই দেখে। জাগরণে যদি অদ্ভুত স্বপ্নগুলো দেখা যেত তাহলে হয়তো অদ্ভুতটা আর উদ্ভট থাকত না!
তিনি দেখলেন- এক সাংবাদিক পাখি তার পাখিটির সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে। কুশল বিনিময়পর্ব শেষে পাখিগুলো পাখিদের ভাষায় কথা বলছে। আফীফ তখন পাখিদের ভাষাও স্পষ্ট বুঝতে পারছে। তাই বিহ্বল বিস্ময়ে তিনি সবকিছু শ্রবণ করছেন।
দীর্ঘসময় সাংবাদিক পাখিটি খাঁচাবদ্ধ পাখিটির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করল। এবং ক্যামেরা ও রেকর্ডারের মাধ্যমে সবকিছু ধারণ করল।
হয়তো আগামী কাল পাখিদের কোন জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ পাবে!
সাক্ষাৎকারটির সারমর্ম ছিল এই-
খাঁচার পাখিটি কিভাবে খাঁচাবদ্ধ হলো, কিভাবে দিন কাটছে, কিভাবে এখান থেকে নিষ্কৃতি পাবে, মানুষের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা কিরূপ এবং সমস্ত পাখিজাতির প্রতি খাঁচাবদ্ধ পাখিটির উপদেশমূলক উদাত্ত আহ্বান।

চার.
সাক্ষাৎকারটি শেষ হওয়ার পূর্বেই আফীফের ঘুম ভাঙে। কিন্তু স্বপ্নে দেখা সাক্ষাৎকারটির কিছু ধ্বনি তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তিনি প্রচ- ভয় পাচ্ছেন এবং দফায় দফায় নিজেকে অভয় দিচ্ছেন। তিনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন খাঁচাবন্দী পাখিটির আর্তনাদ।
তোমরা আমাকে বাঁচাও। আমাকে উদ্ধার করো। আমি স্বাধীনতা চাই।
-এসব শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার কানে।
আফীফ হাসান খুবই রুক্ষ ও রগচটা প্রকৃতির মানুষ। আজকের স্বপ্নটা তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে। স্বপ্নটি দেখার পর তার মন দয়ার্দ্র হয়ে যায়। পাখিটির প্রতি তার সমুদয় ভালোবাসা দয়া ও করুণায় পরিণত হয়। হৃদয় থেকে উৎসারিত হতে থাকে পাখিটির প্রতি প্রীতি। এই পাখিপ্রীতিই তার পাথরপাষাণ অন্তরাত্মা দয়াদাক্ষিণ্যে কোমলময় বানিয়ে দেয়। এভাবে একসময় পাখিটির প্রতি তার ভালোবাসা করুণায় রূপান্তরিত হয়।
তার পাখিপ্রীতি নির্মল হয়ে যায়।
ঠিক তখন সে পাখিটির কাছে যায় এবং হাসিমুখে পাখির খাঁচার দরজা খুলে দেয়।
তৎক্ষণাৎ পাখিটি ফুড়ুৎ করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে বারান্দার ফুলের গাছের ডালে গিয়ে বসে।
তারপর নির্নিমেষ দৃষ্টিতে আফীফের দিকে তাকিয়ে থাকে। আফীফও পাখিটির দিকে প্রীতিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সে লক্ষ করল পাখিটির চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। পাখিটি যেন চোখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তখন আফীফ নির্ঝর ধ্বনিতে হেসে, তির্যক চাহনিতে চেয়ে পাখিটিকে বিদায় দিল। আর তাতে তার আত্মায় এক অপার্থিব প্রশান্তি অনুভব করল।

 

Share.

মন্তব্য করুন