সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে আনিকা। কারণ ছাড়াই আজ সে স্কুলে যায়নি। নাশতাও করেনি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, এখনো পানিটুকু পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। এ নিয়ে তেইশবার ফোন করেছেন আনিকার বাবা আলমগীর সাহেব। কোনোভাবেই মেয়ের মন গলাতে না পেরে অনেকটা হতাশ আনিকার বাবা। আনিকার মাও কম চেষ্টা করেননি মেয়ের মন খারাপের কারণ বের করতে। বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ হলো না। সেই যে দরজা বন্ধ করেছে, এখনো খুলছে না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনিকার আম্মুর টেনশনও বাড়তে লাগল। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার- মনের ভেতর উত্তরহীন প্রশ্নটা খচখচ করছে বিরতিহীনভাবে।
আসলে ‘হঠাৎ’ কিছুই হয়নি। অনেক দিন ধরেই সমস্যাটি ফিল করছে আনিকা। শেষ কয়েকদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাই সে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বলা যায়। আর এ ধাক্কা সামলানোর পথ্য হিসেবে সে গিলছে ‘একাকিত্ব’ নামক মরণ বিষ। সে তো মরছেই, সঙ্গে মারছে বাবা-মাকেও। পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান দরকার। বেশি দেরি হয়ে গেলে মাশুলটাও যে গুনতে হবে বড়। কিন্তু সমাধান হবে কিভাবে? দরজাইতো খুলছে না আনিকা। অধীর অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের।
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে আনিকা নিজেও বুঝতে পারেনি। ঘুম ভেঙেছে কারো হাতের আলতো ছোঁয়ায়। আনিকা জানে বন্ধ ঘরে কে এসেছে? যখনই আনিকা কোন সমস্যায় পড়ে আনিকার এ বন্ধুটি এসে তার সমাধান করে ফেলে এক নিমিষেই। বন্ধুটির নাম রু। রু পরী। আনিকার বেস্ট ফ্রেন্ড। রু পরীকে দেখেই আনিকা অনুযোগের সুরে বলল, ‘রু! আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমার বন্ধুরা আমার সঙ্গে ঠিক মত কথা বলে না। আমার সঙ্গে খেলা করে না। সবসময় আমাকে এ কথা, ও কথা বলে খেপিয়ে রাখে। এভাবে কি জীবন চলে বল? তাই আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে আর স্কুলে যাবো না।’
মনোযোগসহ আনিকার কথা শুনল রু পরী। তারপর বলল, ‘সমস্যা গুরুতর। তবে এর সুন্দর সমাধান কিন্তু আছে আমার কাছে।’
‘সত্যি!’- লাফিয়ে উঠল আনিকা।
রু পরী বলল- ‘আসলে তোমার বন্ধুরা তোমাকে অ-নে-ক ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তা বুঝতে পারছ না। এই যে, তুমি আজ স্কুলে যাওনি নওরীন, জারিন, তাশফিয়া ওরা তোমাকে খুব মিস করছে। ওরা চাইছে কোন মতে স্কুল ছুটি হলেই আগে তোমার বাসায় আসবে। তোমার খোঁজ নিয়ে তারপর তাদের মন শান্ত হবে।
আনিকার মন একটু একটু ভালো হতে শুরু করল। সে বলল, ‘আচ্ছা রু, ওরা যদি আমাকে ভালোই বাসে তাহলে আমাকে খেপায় কেন? আমি তো কখনো ওদের সঙ্গে ভালো ছাড়া খারাপ করি না।’
‘শুনো আনিকা! বন্ধুদের মধ্যে কমবেশি এরকম হয়ই। তুমিও তো নওরীনকে নরি বলে ডাকো। বলো ডাকো না?’
আনিকা মাথা নাড়ল।
তুমি কি জানো এতে নওরীনের কত কষ্ট হয়? দেখ, তারপরও কিন্তু আজ তোমাকে না দেখে ও ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। জারিনকেও তুমি কখনো কখনো মুটি বলে ডেকে ফেল। তারও কিন্তু মন ছটফট করছে তোমাকে দেখার জন্য।’
‘বুঝতে পেরেছি! আমি না জেনেই ওদের ভুল বুঝছিলাম। আর কষ্টে মরে যাচ্ছিলাম। তুমি যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিতে আমি বুঝতেই পারতাম না অকারণে মন খারাপ করছি আর শুধু শুধুই কষ্ট পাচ্ছি।’
‘একদম ঠিক বলেছ। আমাদের বেশির ভাগ মন খারাপই হয় অকারণ আর ভুল বোঝাবুঝির থেকে। এখন আমি আসি। ওই যে তোমার বন্ধুরা চলে এসেছে।’
মুহূর্তেই যেন কোথায় হারিয়ে গেল রু’ পরী। আনিকাদের বাসায় কলিংবেল বেজে উঠল। সে নিজে গিয়ে দরজা খুলে দিল। এতক্ষণে আনিকার মনের আকাশে জমে থাকা মেঘ কেটে রোদ উঁকি দিয়েছে।
রোদের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়েছে আনিকার চোখে মুখে। ঠোঁটের হাসিতে। মুখের কথাতে।

Share.

মন্তব্য করুন