দিল্লি যাবো! উত্তরটা শুনে ভড়কে গেলো ট্রেনে মুখোমুখি বসা এক যাত্রী। বলল, একা যাচ্ছেন? না, আরও দুইজন বন্ধু আছে, তাদের সাথে বেনাপোল মিট হবে। কথা হচ্ছিল খুলনা থেকে বেনাপোলগামী কমিউটার ট্রেনে। নতুন জায়গায় যেতে পছন্দ করি। এবারের ট্যুর একটু লম্বা। কয়েকটা জায়গা ভিজিট করার ইচ্ছা। অনেক দিন ধরে ইচ্ছা ছিল কাশ্মির যাওয়ার। আসলে কাশ্মির এক এক ঋতুতে একেক রূপ। কিন্তু কেউ যদি একবার যেতে চায় তাহলে এপ্রিলের মধ্যভাগ উপযুক্ত সময়।
এ সময় মোটামুটি সব কিছুর স্বাদ পাওয়া যায়। বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেনে টিউলিপ ফোটে এ সময়। তাই বেছে নিলাম এই সময়। তো এবারের প্ল্যান ছিল বেনাপোল দিয়ে ঢুকে কলকাতা, কলকাতা-দিল্লি (বাই এয়ার), দিল্লি-আগ্রা, তাজমহল, দিল্লি-মানালি (বাই বাস), মানালি-শিমলা (বাই বাস), শিমলা-জম্মু (বাই বাস), জম্মু থেকে শ্রীনগর (বাই কার), শ্রীনগর-কলকাতা (বাই এয়ার), এরপর দেশে ব্যাক। মোটামুটি ১৩ দিনের লম্বা ট্যুর।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনে আগের বারের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে একটু টেনশনে ছিলাম। এবার সহজে ছাড়বো না, মনে মনে বললাম। সিক্রেট ক্যামেরা এপ চালু করে মোবাইলটা বুক পকেটে রাখলাম। যাই হোক, ভিডিওসহ পাবলিশ হবে। কিন্তু এবারের ইমিগ্রেশন পুলিশ গতবারের উল্টা। কী করেন জিজ্ঞাসা করল, বললাম স্টুডেন্ট। কোথায়? সেটাও বললাম। এইবার সে আমাদের সাথে পুরো গল্প জুড়ে দিল। তার ভাতিজা চুয়েটে পড়ে সেটাও বলতে ভুলল না। পেছনে লম্বা লাইন, আর আমাদের সাথে তার গল্পই শেষ হয় না। বিরক্ত হলেও মুখে হাসি হাসি ভাব ধরে রাখছি। গল্প শেষ পর্যন্ত বিসিএস পুলিশ পর্যন্ত গড়াল। বিসিএস পুলিশের পাওয়ার স¤পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিল। এবং শেষে আমাদের বিসিএস দিয়ে পুলিশে জয়েন করার উৎসাহ দিল। আমরা হাসি মুখে তার ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা বলে দ্রুত সটকে পড়লাম।
ইন্ডিয়া ইমিগ্রেশনের অংশে প্রবেশ করলাম। আমি যে লাইনে দাঁড়ালাম, সেই লাইনের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার ব্যবহার এত বাজে ছিল বাংলাদেশের হলে নির্ঘাত মা’র খেত। তুই ছাড়া তার মুখ থেকে কোন কথাই বের হয় না। আস্তে করে সেই লাইন ছেড়ে পাশের লাইনে দাঁড়ালাম। এখানে চমৎকার ব্যবহার পেলাম। হাসি মুখে সবাইকে সে ওয়েলকাম করছিল।
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাসে উঠলাম। দুপুরের কিছু পরে কলকাতা পৌঁছুলাম। মোবাইলের সিম কিনে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। আগেরবার কেনা ভোডাফোন সিমটা অ্যাক্টিভ ছিল, তারপরেও আরেকটা এয়ারটেলের সিম কিনলাম। রিস্ক নিই নাই। প্লেন ছিল রাত ৮টার দিকে। আসলে প্লেনের টিকেট প্রায় এক মাস আগে করছিলাম অনলাইনে। আগে করলে অনেক কমে পাওয়া যায়।
আবার অফপিক টাইমে ডিপারচার হলেও কমে টিকেট পাওয়া যায়। বিকালের টিকিট এর দাম বেশি ছিল দেখে রাতের টিকিট কাটছিলাম। রাতে তো আর আমাদের সমস্যা নেই।
হাতে অনেক সময় আছে। তাই হাওড়া ব্রিজে ঘোরাঘুরি করলাম। ব্রিজের নিচে তাকিয়ে দ্বীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কারণ এ পানি আমাদের অধিকারের পানি। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পদ্মা নদীর পানি এই নদীতে ডাইভার্ট করা হচ্ছে। মেট্রো রেলে (পাতাল) উঠলাম প্রথমবারের মতো। স্টেশনে একজন কলকাতার ভদ্রলোকের সাথে ট্রেন নিয়ে কথা হচ্ছিল। কোন প্লাটফর্মের ট্রেন কোথায় যাবে এইসব নিয়ে। সে হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছিল। শেষে আমাদের জিজ্ঞাসা করল কোথা থেকে আসছেন, বাংলাদেশ বলতে তার মুখটা বাংলা পাঁচের মতো হয়ে গেল, বলল ‘টিকিট কাটছ?’ পুরো তাজ্জব হয়ে গেলাম আমরা। সন্ধ্যার পর খাওয়া দাওয়া সেরে কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করলাম। এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি পুলিশ হিন্দিতে কথা বলছিল আমাদের সাথে। বাংলার সাথে হিন্দির অনেক মিল থাকায় তার কিছু কিছু কথা বুঝছিলাম। উত্তর দিচ্ছিলাম ইংলিশে। সে আমাদের হিন্দি শিখতে বলল। হিন্দি যে একটা ভদ্র এবং বিনয়ী ভাষা সেটাও বলল এবং প্রমাণ স্বরূপ হিন্দি কথা শেষে ‘লিজিয়ে’ শব্দ যুক্ত করে বিনয়ী করা হয় হাসি মুখে সেটাও বলল। আমিও তাকে বললাম বাংলা, হিন্দি, উর্দু আর আরবি ভাষা গানের জন্য খুবই ভালো।

বোর্ডিং পাসে যে গেটের নাম্বার উল্লেখ ছিল সেদিকে যাচ্ছিলাম। একটা ছেলে এসে আমাদের বলল, আপনারা দিল্লির ফ্লাইটে যাবেন? ওটার গেট চেঞ্জ হয়েছে। নতুন গেট এদিকে আসেন। আমার বন্ধু দুইজন তার পিছে হাঁটা শুরু করল। আমি ওদের দুইজনকে টান দিয়ে বললাম, লোকটা ফ্রডও হতে পারে। আগে আমরা যেয়ে চেক করে দেখে আসি। যেয়ে দেখি সত্যি সত্যি গেট চেঞ্জ হয়েছে। ফ্লাইট ছিল ৮:৫০ এ। কিন্তু যাত্রী সব উঠে পড়ায় ২০ মিনিট আগেই প্লেন ছেড়ে দেয়। এবার আর আগের মত ভুল করিনি। টিকেট কাটার সময় সফট ড্রিঙ্কস এর অর্ডার দিয়ে রাখছিলাম। রাত ১১টার দিকে সহিহ সালামতে দিল্লি পৌঁছুলাম। রাতে হোটেল খোঁজা ঝামেলা হবে বলে আগে থেকে অনলাইনে বুকিং দিয়ে রাখছিলাম। একটা অটো নিয়ে গুগল ম্যাপ ধরে চলে গেলাম হোটেলে। হোটেলে পৌঁছে ঘুম।
সফরের দ্বিতীয় দিন। এইদিন আগ্রা যাওয়ার প্ল্যান। প্ল্যান ছিল ট্রেনে যাওয়া আসার। স্টেশনে যেয়ে দেখি সকালের আগ্রাগামী সকল ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। অগত্যা কাশ্মিরি গেটে গেলাম একটা অটো নিয়ে, যদি আগ্রাগামী বাস পাওয়া যায়। একটা ট্যুরিস্ট বাস পেলাম, যেটা আগ্রা দুর্গ আর তাজমহল ঘুরে দেখাবে এবং আপডাউন সহ। সাধারণত এরকম ট্যুরিস্ট বাসে আমি যেতে চাই না, কারণ ওদের ইচ্ছামত ঘুরায়, নিজের ইচ্ছামত ঘোরা যায় না। কিন্তু আর কোন পথ না থাকায় এই বাসে উঠে পড়লাম।
দিল্লি থেকে আগ্রা হাইওয়ে ৮ লেনের। নতুন তৈরি করেছে এবং এক্সপ্রেসওয়ে। আশপাশের ছোটখাটো রোড এর সাথে সংযুক্ত থাকবে না। হাই ¯িপডে চালানোর জন্য এই রোড। কিন্তু আমাদের বাস দেখলাম কখনও ৮০ কিলোর ওপরে উঠল না। সিরিয়াসলি মেজাজ গরম হচ্ছিল। এত সুন্দর রোডে এত আস্তে চালায় রোডের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের দেশের এনা বাসের ড্রাইভার এই রাস্তা পেলে নির্ঘাত বিমানের আগে চলে যেত। ইন্ডিয়াতে একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে এরা বাস আস্তে চালায়। এই হাইওয়েতে আরও একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে, রাস্তার বেশির ভাগ অংশে পিচ না দিয়ে কনক্রিটের ঢালাই করা। এখানে তাপমাত্রা বেশি, সম্ভবত সূর্যের তাপে পিচ গলে যায় এই কারণে ঢালাই করা হতে পারে। দিল্লিতে দিনে প্রচ- গরম। আবার রাতে ঠা-া পড়ে। মরুভূমি ইফেক্ট। বাসে বহুত কিসিমের মানুষ। কলকাতার, আসামের ও সাউথ ইন্ডিয়ার লোক ছিল। একজন বাংলাদেশীও পেয়েছিলাম। বাসে কেরালার কয়েকজন মুসলিম ছিল। তাদের সাথে পরিচিত হলাম ও কথা বললাম। তারা কেরালা ভিজিটের আমন্ত্রণ জানালো। আমরাও তাদের বাংলাদেশ ভিজিটের আমন্ত্রণ জানালাম। আগ্রা দুর্গে পৌঁছুলাম। আগ্রা দুর্গ দেখে আমি আসলে পুরোপুরি বিস্মিত ও চমৎকৃত। অসাধারণ আর্কিটেকচার। মোগল বাদশাহরা যে কিভাবে এ জিনিস বানিয়ে গেছেন! দুর্গের কিছু অংশ ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত। বাকি অংশে ইন্ডিয়ান আর্মি থাকে। আসলে ব্রিটিশ আমলেও এখানে ব্রিটিশ আর্মি থাকত, তারই ধারাবাহিকতায় এখন ইন্ডিয়ান আর্মি থাকে (ট্যুর গাইডের ভাষ্য অনুযায়ী)। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো এখান থেকে মুসলিম ও ইসলাম জিনিসটাকে সচেতনভাবে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি দুর্গের মধ্যে মতি মসজিদের মধ্যে ঢোকা যায় না। দুর্গের গেটের সামনে রাস্তায় শিবাজীর মূর্তি বানিয়ে রাখা হয়েছে যেটা রিসেন্ট বানানো হয়েছে। বুঝলাম না এই দুর্গের সাথে শিবাজীর কী স¤পর্ক? ইন্ডিয়ানদের কাছে সম্রাট আকবর প্রিয়, আর আওরঙ্গজেব খারাপ। তবে মুসলিমদের কাছে আওরঙ্গজেব প্রিয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মোগল সম্রাটরা সবাই যদি আওরঙ্গজেবের মত হতেন তাহলে এই উপমহাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত হতো।
এরপর তাজমহল দেখার পালা। তাজমহলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। অসাধারণ আর্কিটেকচার। এখানেও সচেতনভাবে মুসলিম ঐতিহ্যটাকে এভয়েড করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তাজমহলের পশ্চিমপাশে বড় একটি মসজিদ যেটা তাজমহলের অংশ। মসজিদে নামাজ পড়তে হলে তাজমহল পেছনে থাকবে এরকমভাবে নির্মিত। তাজমহলটাকে সুন্দর করে মেরামত ও পরিষ্কার করলেও মসজিদটাকে একদম অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে। পুরো অপরিষ্কার এবং সমস্ত জায়গায় কবুতরের পায়খানা ছড়িয়ে ছিল। মসজিদের ফাটলগুলো কোন রকমে সিমেন্ট বালি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে এবং এর ফলে সুন্দর ক্যালিগ্রাফির অনেক অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদে জোহর আর আসর একসাথে পড়ে নিলাম। এরপর তাজমহল দেখা শেষে আমাদের দুটো মন্দির পরিদর্শন করতে নিয়ে গেল। ভালো লাগছিল না বলে আমি বাসে বসে ছিলাম। একজন লোককে দেখলাম একটা দোকানের সামনে একটা গরুকে প্রণাম করছে খুব ভক্তিসহকারে। কিছুক্ষণ পর দেখি দোকানদার চেয়ার দিয়ে গরুটাকে পিটিয়ে তাড়াাচ্ছে তার দোকানের সামনে থেকে। দেখে প্রচ- হাসি পেল।

দিল্লি ফিরতে রাত প্রায় ২টা বেজে গেল। বাস হোটেলের কাছাকাছি নামিয়ে দিলো। রুমে পৌঁছেই ঘুম।
সফরের তৃতীয় দিন। আগ্রা থেকে ফেরার পথে সফরসঙ্গী বন্ধুর একজন জ্বর বাধিয়ে ফেলল এবং দুঃখজনকভাবে সফরের বাকি ১১ দিন তার জ্বর কমেনি। সফরটা তার একদম মাটি হয়ে গেল।
আমাদের সাথে কোথাও ঘুরতেও পারেনি। সারাদিন হোটেলে থেকেছে আর টিভিতে মুভি দেখে টাইম পাস করেছে।

সকালে একটু দেরি করে হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে দিল্লি দেখতে বের হলাম। আবার ঐদিন রাতে মানালি যেতে হবে। তাই সরাসরি চলে গেলাম কাশ্মিরি গেটে। সেখান থেকে রাতের মানালিগামী বাসের টিকেট কেটে রাখলাম। তারপর দিল্লির রেড ফোর্ট, দিল্লি গেট, সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ভবন ও শেষে দিল্লি শাহি মসজিদ দেখলাম। এই মসজিদে জোহর, আসর, মাগরিব ও এশার নামাজ পড়লাম। মসজিদ প্রাঙ্গণে দেখলাম ধর্ম নির্বিশেষে নারী-পুরুষের ভিড়। নির্দেশনা থাকলেও অপ্রীতিকর ড্রেস পরা কিছু মেয়েদেরকেও দেখা গেল। শিরক এর কিছু নিদর্শনও দেখতে পেলাম এখানে। আসলে মসজিদ প্রাঙ্গণে ধর্ম নির্বিশেষে লোকেরা অবস্থান করে রহমত পাওয়া, রোগমুক্তি ও ইচ্ছাপূরণের আশায়। সময় না পাওয়ায় কুতুব মিনার দেখা হয়নি। রেড ফোর্টেও সচেতনভাবে ইসলাম জিনিসটাকে এভয়েড করার চেষ্টা দেখলাম। দুর্গের ভেতর মসজিদটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। রাতে শাহি মসজিদের পাশে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। সত্যি বলতে সফরের ২ দিন পরে এখানে ভালোভাবে খেতে পারলাম। বলা যায় কব্জি ডুবিয়ে মুরগি খেলাম। আগের দুই দিনের খাবার ভালো ছিল না। খাওয়া সেরে দ্রুত কাশ্মিরি গেটে গেলাম। রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে এবং বাসের টাইম চলে আসার কারণে ট্যাক্সি ছেড়ে প্রায় ৩ কিলো হেঁটে কাশ্মিরি গেটে পৌঁছুলাম। টিকেট সেলার দেরি হওয়ার কারণে বার বার ফোন দিচ্ছিল। সেখান থেকে একটা রিক্সা জাতীয় বাহন নিয়ে গেলাম ‘মজনু কা টিল্লা’তে। সেখানে আমাদের বাস ছিল। সময় মত পৌঁছুলাম এবং বাস চড়ে বসলাম। আমাদের সিট পেছনের দিকে ছিল। আমরা ৩ জন থাকায় আমার পাশের সিট ফাঁকা ছিল তাই রিলাক্সে একটা কম্বল মাথার তলায় দিয়ে বালিশ বানালাম আর একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে সটান হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন মানে সফরের চতুর্থ দিন দুপুরের দিকে মানালি পৌঁছুলাম। অনেক লং জার্নি, প্রায় ১৫ ঘণ্টা। মনে করছিলাম পাহাড়ি রোড অনেক দুর্গম বা ভয়ঙ্কর হবে। আসলে তেমন কিছু ছিল না। রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত ছিল। অনলাইনে বাসে বসে হোটেল বুকিং দিয়ে ফেললাম। বাস থেকে নেমে একটা অটো নিয়ে বুক করা হোটেলে চলে গেলাম। সফরসঙ্গী জ্বরে আক্রান্ত বন্ধু এত সময় পর একটু শান্তি পেল।

মানালিতে আসলে অনেক ঠা-া ছিল। বিকেলে আমি আর আমার আর এক বন্ধু মল রোডের আশপাশে ঘুরতে বের হলাম। ভালো একটা হালাল রেস্টুরেন্ট পেলাম। দুইজনে আস্ত একটা মুরগির কাবাব খেয়ে ফেললাম। খাবারটা খুব চমৎকার ছিল। পরে মানালিতে যে কয় বেলা খেয়েছি এই রেস্টুরেন্টে খেয়েছি। পরের দিন মানালি ঘোরার জন্য একটা গাড়ি রিজার্ভ করে রাখলাম। আগেই বলেছি আমি অন্যদের সাথে শেয়ার করে ভ্রমণ পছন্দ করি না, তাতে ইচ্ছামত ঘোরা যায় না। তাই খরচ বেশি হলেও গাড়ি ঠিক করা হলো।
এখন যে বন্ধুটি জ্বরে হোটেলে পড়ে আছে তার জন্য ঔষধ কেনার পালা। ঔষধ কিনতে ঔষধের জেনেরিক নাম ধরে কিনলাম, কারণ ইন্ডিয়ার ঔষধের নাম আমাদের দেশ থেকে ভিন্ন হবে।
সাপোজিটরি খুঁজলাম সারা মানালিতে। কিন্তু কেউ সাপজিটরি চেনে না। হয়তবা ইন্ডিয়াতে সাপোজিটরি নেই অথবা অন্য কোন নামে আছে বা সব দোকানে থাকে না। আর দোকানদারকে বুঝাতেও পারছিলাম না জিনিসটা আসলে কী। পরে কাশ্মিরে যেয়েও পাইনি।

সফরের ৫ম দিন। সকালে হোটেল ছেড়ে দিয়ে গতকালের ঠিক করে রাখা গাড়িতে ঘুরতে বের হলাম মানালি। আমাদের প্ল্যান ছিল মানালি দেখার পর শিমলা যাওয়ার। কিন্তু মানালি দেখে তেমন ইমপ্রেসড হইনি, তেমন ভালোও লাগেনি। তাই গতকাল ইনস্ট্যান্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমরা শিমলা যাবো না।
মানালি থেকে সরাসরি কাশ্মির যাবো। আসলে তখন মনটা কাশ্মিরে চলে গেছে। এই চিন্তার পালে হাওয়া লাগল যখন দেখলাম বিকেলে মানালি থেকে জম্মুর একটা বাস আছে। ঝটপট সেই বাসের টিকিট করে ফেললাম। এ কাজটা করেছিলাম সফরের ৪র্থ দিনেই।
তো এখন মানালি ঘোরার পালা। প্রথমে গেলাম সোলাং ভ্যালি। ঘোড়ায় চড়ে কিলোমিটার খানেক যাওয়া যায়। আবার হেঁটেও যাওয়া যায়। আমরা ঘোড়ায় চড়ে গেলাম। চারিদিকে শুধু ধুলো আর ধুলো। প্রচ- খারাপ লাগছিল। সোলাং ভ্যালিতে একটা জায়গায় অল্প কিছু স্নো ছিল। হাজার হাজার লোক সেই অল্প স্নোর ওপরে লাফালাফি করে সাদা স্নো কালো বানিয়ে ফেলেছে। তাও যা স্নো ছিল পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা। আমরা যখন মানালি ছিলাম তখন বরফ পড়ে না। সম্ভবত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পড়ে। প্রচুর ইউরোপিয়ান ও পশ্চিমবঙ্গের আর সাউথ ইন্ডিয়ার ট্যুরিস্ট দেখলাম এখানে। সোলাং ভ্যালিতে যাওয়ার আগে রোবোকপ মার্কা শীতের ড্রেস ভাড়া করতে হয়। কিন্তু এই ড্রেস আমাদের কোনো কাজেই আসেনি। বেহুদাই অন্যদের দেখাদেখি ভাড়া নিচ্ছিলাম। সোলাং ভ্যালিতে বরফের ওপর ওঠার পূর্ব মুহূর্তে এক সাউথ ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক (ফিরে আসছিল) তার হাতমোজাটা আমাকে সেধে দিয়ে দিল, সাথে তার ওয়াইফও ছিল। দুইজনে তামিল টাইপের কিছু একটা বলাবলি করে আমাকে দিয়ে দিল। কি মনে করে দিল আমি বুঝলাম না।
থ্যাংক দিয়ে নিয়ে নিলাম। আসলে এত ঠা-া ছিল না, যাতে হাতমোজার দরকার হয়। কালো বরফের ওপর কিছুক্ষণ লাফালাফি করে ঘোড়ায় চড়ে আবার ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। আসার পথে ফ্রি পাওয়া হাতমোজাটাও একজনকে দিয়ে দিলাম। এবার যাবো রোথাং পাস। কিন্তু রোথাং পাস জুনের মাঝামাঝি খোলে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খোলা থাকে। বাকি সময় বরফে ঢাকা থাকে। গাড়ি থেকে নেমে অনেকখানি পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় ৪-৫ কিলো হেঁটে রোথাং পাসের কাছাকাছি গেলাম। আবার হেঁটে ফিরে এলাম। শরীরের অবস্থা হালুয়া টাইট হয়ে গেল।
এ দিকে বিকেল ৫টার সময় আমাদের জম্মুর বাস। সে সময়ও কাছে চলে আসছে। তাড়াতাড়ি মলরোডে ফিরে এলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে একটা অটো নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। দেরি হচ্ছিল দেখে বার বার বাসের কণ্টাক্টর ফোন দিচ্ছিল। পৌঁছে দেখি বাসের সব যাত্রী চলে আসছে। আমরা বাকি আছি। আমরা সিটে বসা মাত্রই বাস ছেড়ে দিল জম্মুর উদ্দেশে। আমার সামনের সিটে আমার দুই বন্ধু, আর পেছনের সিটে আমি একা, আমার পাশে একজন অচেনা ছেলে। চেহারা দেখে পশ্চিমা কোন দেশের মনে হলো। আমি হাই হ্যালো দিয়ে কথা বলা শুরু করলাম তার সাথে। সে বলল সে কাশ্মিরি। আমরা বাংলাদেশের শুনে খুব খুশি হলো এবং মুসলিম শুনে আরও বেশি খুশি হলো। ইন্ডিয়ার সমস্ত জায়গায় বাংলাদেশ পরিচয়ে অবজ্ঞা পাবেন। একমাত্র কাশ্মিরে বাংলাদেশ পরিচয়ে সম্মান পাবেন। যেটা কাশ্মিরে না গেলে বোঝা যাবে না। কাশ্মিরিদের ফেভারেট ক্রিকেট টিম বাংলাদেশ আর পাকিস্তান। ইন্ডিয়ার কোনো বেল নেই ওদের কাছে। বাংলাদেশ হারলে তারা কষ্ট পায় আমাদের মতো।
কাশ্মিরি ছেলেটার সাথে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর শুরু হলো বিভিন্ন কথাবার্তা। সে কথার কোনো আগা মাথা নেই। এক ইস্যু থেকে আরেক ইস্যু। এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়। মনে হচ্ছিল দুই বন্ধুর অনেক দিন পর দেখা। আমি ইংলিশে বলছিলাম আর সে হিন্দিতে বলছিল। সে ভালো ইংলিশ জানে না। আমিও ভালো হিন্দি জানি না। তবুও ইয়েস, নো, ভেরিগুড দিয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার মানালিতে দোকান আছে, কাশ্মিরি শাল ও জামাকাপড়ের। ছয় মাস পর বাড়ি যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট সিজনে মানালি থাকে। কাশ্মিরের বহু বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হলো তার সাথে। আমাদের সিটের অপজিট সাইডে দুইজন বাংলাদেশী পেলাম। তারা জয়পুর, শিমলা, মানালি হয়ে জম্মু যাচ্ছে। সেখান থেকে তারা ট্রেনে কলকাতা ব্যাক করবে, শ্রীনগর যাবে না। তাদের সাথে কথাবার্তা হলো। আমরা শিমলা স্কিপ করেছি জেনে বলল ঠিক করেছেন, তেমন কিছু নেই। এবং আরও বলল তার থেকে মানালি ভালো। রাত আস্তে আস্তে গভীর হতে থাকল। সারা দিনের অনেক ধকলের পর ঘুমিয়ে পড়লাম কখন টেরই পাইনি।
সফরের ৬ষ্ঠ দিন। ভোর ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। গুগল ম্যাপ ওপেন করে দেখলাম জম্মু এখনও দূরে আছে। আগেই জানতে পেরেছিলাম যে জম্মু ও কাশ্মিরে প্রিপেইড সিম নেটওয়ার্ক কাজ করে না। শুধুমাত্র পোস্টপেইড সিম কাজ করবে। আর ট্যুরিস্টদের পোস্টপেইড দেয়া হয় না। তাই দেশে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে রাখলাম বাকি কয়দিন নেটওয়ার্ক এর বাইরে থাকব। অযথা যেন টেনশন না করে। প্রায় ৬-৭ দিন নেটওয়ার্কের বাইরের থাকার থ্রিল অনুভব করছিলাম। সকাল ৬টার দিকে বাস যখন জম্মুতে প্রবেশ করল তখন মোবাইলের নেটওয়ার্ক হাওয়া হয়ে গেল। অজানা একটা আশঙ্কা ভর করল মনে। সাড়ে ৬টার দিকে বাস থেকে নামলাম। এরপর আরেকটা গাড়িতে যেতে হবে শ্রীনগর, প্রায় ১০ থেকে ১১ ঘন্টা লাগবে যেতে। বলে রাখা ভালো যে কাশ্মির বলে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। ভারতের এই রাজ্যের নাম জম্মু অ্যান্ড কাশ্মির। রাজ্যের দক্ষিণ সাইড জম্মু নাম আর গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হলো শ্রীনগর, যেটা রাজ্যের উত্তর দিকে। মূলত কাশ্মিরের সব ট্যুরিস্ট স্পটই শ্রীনগরকে কেন্দ্র করে। শ্রীনগরে আছে ডাল লেক, মোগল বাদশাহদের বিখ্যাত গার্ডেনগুলো আর হযরতবাল মসজিদ। থাকার ব্যবস্থাও শ্রীনগরে। এখন শ্রীনগরের গাড়ি ঠিক করার পালা। আমার পাশের সিটের সেই কাশ্মিরি ছেলেটা বলল যে, আপনাদের কাছে বেশি ভাড়া চাইতে পারে। আপনারা কোন কথা বইলেন না, গাড়ি আমি কমে ঠিক করে ফেলতে পারব। সে টাটা সুমো গাড়ি ৮০০ রুপি করে ঠিক করল শেয়ার ব্যাসিসে। আমি পাশে দেখলাম একটা প্রায় নতুন গাড়ি আছে, সম্ভবত টয়োটা প্রিমিয়ো ছিল। তার ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম তার গাড়ি কততে যাবে। সে বলল ফোর থাউজ্যান্ড অ্যান্ড হাফ। আমি বললাম ফোর থাউজ্যান্ড উইল বি ওকে ফর আস। সে রাজি হলো। আমি কাশ্মিরি ছেলেটাকে বললাম যে, আপনি ৮০০ রুপিই দিয়েন বাকি ৩২০০ আমরা দিয়ে দেবো। সে রাজি হলো। আমরা ৪ জন গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়িতে এসি ও হিটার ছিল।

এখানে ইন্টারেস্টিং এবং আমাদের সবচেয়ে সুবিধা হয়েছে যে এই গাড়ির ড্রাইভার ফ্লুয়েন্ট ইন ইংলিশ। আমাদের থেকেও ভালো ইংরেজি পারে। তার ফ্লুয়েন্সির মাত্রা নেটিভ ¯িপকারের মতো। যেখানে কাশ্মিরের অফিসিয়াল ভাষা উর্দু আর কাশ্মিরিরা কাশ্মিরি ভাষায় কথা বলে সেখানে একজন ইংলিশ ¯িপকার ড্রাইভার পেয়ে আমাদের অনেক সুবিধা হলো, এবং কাশ্মিরে যে কয়দিন ঘুরেছি এই গাড়ি ও এই ড্রাইভারের সাথে ঘুরেছি। তার ইংলিশ ফ্লুয়েন্সি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম হয়ত সে পশ্চিমা কোন দেশে ছিল প্রবাসী হিসেবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সে জানাল, মারুতি কো¤পানিতে চাকরি করত, সেখান থেকে এই শেখা।

কিছু দূর যাওয়ার পর নতুন একটা বিপদ টের পেলাম। জম্মু থেকে শ্রীনগর হাইওয়ে হলো ওয়ানওয়ে। মানে একদিন গাড়ি জম্মু থেকে শ্রীনগর যাবে এর পরদিন শ্রীনগর থেকে জম্মু আসবে। আমাদের বিপদটা হলো ঐদিন ট্রাফিক শ্রীনগর থেকে জম্মু। সামনে পুলিশের চেকপোস্ট। চেকপোস্টের পুলিশের যদি মনে হয় এই গাড়ি ছাড়া যায় তাহলে ছাড়বে, না হলে একদিন জম্মুতে আটকে পড়ে থাকতে হবে।
চেকপোস্টের আগে একজন বাদে বাকি সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আল্লাহর রহমতে আমাদের গাড়িকে চেকপোস্টে আটকালো না। হয়ত ড্রাইভার সামনে অল্প কিছুদূর যাবো এ রকম কিছু বলে পার পেয়েছে। কাশ্মিরি ছেলেটা আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে দুই বন্ধুর মত হেঁটে চেকপোস্ট পার করিয়ে নিয়ে গেল, যাতে যাত্রী হিসেবে বোঝা না যায়। চেকপোস্টের প্রায় ৫০০ মিটার দূরে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা চেকপোস্ট পার হয়ে দৌড়ে গাড়িতে যেয়ে বসলাম। বসা মাত্রই গাড়ি দৌড়। দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল, বাংলাদেশে তখন পয়লা বৈশাখের উৎসব চলছে। ঠিক ঐ সময়ে ছুটে চলেছি জম্মু থেকে স্বপ্নের কাশ্মির উপত্যকার দিকে। কিছু দূর যাওয়ার পর সামনে পড়ল ‘চেনানি নাশরি’ টানেল। যেটার দৈর্ঘ্য ৯.২ কিলোমিটার এবং এর ফলে ৪১ কিলোমিটার দূরত্ব কমে গেছে এবং সেই সাথে ২ ঘণ্টার পথ। টানেলটি ইন্ডিয়ার দীর্ঘতম টানেল এবং উদ্বোধন হয়েছিল ২ এপ্রিল অর্থাৎ আমরা যাওয়ার ১২ দিন আগে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ির উল্টোস্রোত ঠেলে এগিয়ে চললাম আমরা। আগেই বলেছিলাম আমাদের মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। আমাদের এ দুরবস্থা দেখে কাশ্মিরি ছেলেটা নিজ ইচ্ছায় তার মোবাইলকে হট¯পট করে দিলো। আমি ধুমছে নেট ইউজ করলাম, বাসায় কল করলাম, ফেসবুকে শুভ নববর্ষ জানিয়ে স্ট্যাটাস দিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার নেট শেষ হয়ে যাবে কি না, সে জানালো তার সিমে আনলিমিটেড নেটের একটা অফার আছে, সো কোন সমস্যা নেই। বিনিময়ে আমার পাওয়ার ব্যাংকটা তাকে দিলাম যাতে তার ফোন বন্ধ হয়ে না যায়। তার সাথে ফেসবুকের ফ্রেন্ডশিপটাও গড়ে ফেললাম।
জওহরলাল নেহরু টানেল পার হওয়ার পর হঠাৎ করে একধরনের ঠান্ডা আর স্নিগ্ধ আবহাওয়া টের পেলাম। বুঝলাম কাশ্মির উপত্যকায় প্রবেশ করেছি। পাহাড়ি রোড শেষ, সমতল ভূমি শুরু। ড্রাইভার বলল যে, সামনের চেকপোস্টে পুলিশ কোথা থেকে আসছেন জিজ্ঞাসা করলে জম্মুর কথা যেন না বলি, অন্য একটা জায়গার নাম বলতে বলল, জায়গাটার নাম অবশ্য ভুলে গেছি। তবে চেকপোস্টে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। বিকেল ৫টার দিকে আমরা শ্রীনগরে প্রবেশ করলাম।

কয়েকটা বিলবোর্ডে দূর থেকে বাংলাদেশ লেখা চোখে পড়ল। উৎসাহী হয়ে তাকালাম। লেখা ঝঃঁফু গইইঝ রহ ইধহমষধফবংয. নিচে কতগুলো মেডিক্যাল কলেজের নাম লেখা যেগুলোর নাম জীবনেও শুনিনি। কাশ্মির থেকে প্রচুর সংখ্যক ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে পড়ালেখা করে। কাশ্মিরে বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোর ভালো গ্রহণযোগ্যতা আছে। এ ছাড়াও ইন্ডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে খরচ কম। আর সবচেয়ে বড় যে ফ্যাক্টরটা সেটা হলো বাংলাদেশ মুসলিম দেশ, গার্ডিয়ানরা বাংলাদেশকে ইন্ডিয়ার তুলনায় সেফ মনে করেন।
আমরা শ্রীনগর পৌঁছুলাম। শেষ হলো মানালি থেকে শ্রীনগরের প্রায় ২৪ ঘণ্টার রোড জার্নি। ড্রাইভার আমাদের সব থেকে দামি একটা হোটেলের সামনে নিয়ে রাখল। রিসিপশনে যেয়ে ভাড়া জানতে পারলাম ৬ হাজার রুপি পার ডে। মান সম্মান গুলিয়ে খেয়ে ফিরে চলে এলাম। পরে দু-একটা হোটেল ঘুরে দেখলাম কেউ ওয়াইফাই দিতে পারবে না। আর আমাদের ওয়াইফাই লাগবে, যেহেতু আমাদের মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। এরপর ড্রাইভারের নাম্বারটা রেখে দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম।
এবার ওয়াইফাই ওয়ালা হোটেল খোঁজার পালা। কিছু হোটেলে দেখলাম বাংলা অক্ষরে হোটেলের নাম লেখা। কিন্তু হোটেলে যেয়ে কোন বাংলাভাষী
কাউকে পেলাম না। ওরা এরকম লিখে রাখে বাঙালিদের আকর্ষণের জন্য। এভাবে ৫-৬টা হোটেলে ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু ওয়াইফাই নেই। কাশ্মিরে সিকিউরিটি জনিত সমস্যার কারণে কেউ ওয়াইফাই দিতে চায় না। কাশ্মির একটা ওপেন কারাগার। অনেকক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে এদের স্বাধীনতা নেই। শেষমেশ একটা হিন্দু হোটেল পেলাম যেটা আমাদের ওয়াইফাই দিতে পারবে। তাও ফ্রি না। ২৪ ঘণ্টা, ৩০০ মেগা, দাম পড়বে ১০০ রুপি এবং নাম ঠিকানা দিয়ে রেজিঃ করার পর সে ওয়াইফাই পাওয়া যাবে। আমরা চোখ বুজে বললাম রাজি। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। হোটেলটাও চমৎকার ছিল। ভাড়ার তুলনায় হোটেলটা উন্নতমানের ছিল অন্য হোটেলগুলোর চেয়ে। গিজার, রুম হিটার সব ছিল। প্রথমে আমরা হোটেলটা ১ দিনের জন্য নিই। প্ল্যান ছিল পরের দিন যদি অন্য কোনো ফ্রি ওয়াইফাই ওয়ালা হোটেল পাই তাহলে এটা ছেড়ে দিয়ে সেটাতে উঠব। কিন্তু হোটেলটা ভালো লাগায় ও এর থেকে কমে এই সুবিধায় অন্য ভালো হোটেল না পাওয়ায় বাকি ৬ দিনই এই হোটেলে ছিলাম। যাই হোক অন্তত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার টেনশনটা কমল আমাদের।
ট্যুরের ৭ম দিন। যেহেতু আমরা শিমলা যাইনি, তাই হাতে এক্সট্রা একদিন ফ্রি পড়ে থাকল। তাই ভাবলাম এই দিনটা রেস্ট নিই। আবার এদিকে অসুস্থ বন্ধুটি এখনও সুস্থ হয়নি। তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছেও যাওয়া দরকার। দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে বিকেলের দিকে অসুস্থ বন্ধুটিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কাশ্মিরের একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতাল। যেয়ে ডাক্তার পেলাম। তিনি লন্ডন থেকে পড়াশুনা করেছেন। ব্যবহার অনেক ভালো। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন। তার মধ্যে ম্যালেরিয়া টেস্ট ছিল। মূলত দিল্লি ছিলাম জানতে পেরে ম্যালেরিয়া টেস্ট দিয়েছিলেন। দিল্লিতে নাকি ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আছে। ম্যালেরিয়া টেস্ট ওই হাসপাতালে না থাকায় বাইরে আরেকটি জায়গায় গিয়ে করা লাগল। ওখানে ঔষধ ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টের খরচ বাংলাদেশ থেকে অনেক কম। যাই হোক আল্লাহর রহমতে ম্যালেরিয়া ধরা পড়ল না। সাধারণ জ্বর। ডাক্তার কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করলেন প্রতিদিন দু’টি ইনজেকশনসহ। হাসপাতালে একটি কাশ্মিরি ছেলের সাথে পরিচয় হলো। কথা হলো তার সাথে। বাংলাদেশ জেনে ছেলেটি আগ্রহভরে আমাদের সাথে কথা বলল। সে বাংলাদেশে মেডিক্যালে পড়তে আসতে চায়। সে স¤পর্কে কিছু ইনফরমেশন নিলো। মূলত সে জানাল ইন্ডিয়ায় কি একটা পরীক্ষা আছে সেখানে মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার জন্য, যদি চান্স না পায় তাহলে সে বাংলাদেশে গিয়ে মেডিক্যালে পড়বে। তার কিছু বন্ধুও বাংলাদেশে পড়ে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাংলাদেশ কেন যেখানে ইন্ডিয়াতে ভালো মেডিক্যাল কলেজ আছে। সে সরাসরি বলল মুসলিম দেশ তাই।

অষ্টম দিন। যে ড্রাইভারের সাথে জম্মু থেকে কাশ্মির আসছিলাম সে ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। এদিন তার গাড়িতে সোনমার্গ গেলাম অসুস্থ বন্ধুটিকে হোটেলে রেখে। কাশ্মিরের ট্যুরিস্ট ¯পটগুলোতে অনেক বলিউড ফিল্মের শুটিং হয়েছে। এখানে রিসেন্ট বাজরাঙ্গী ভাইজানের শুটিং হয়েছে। সোনমার্গে যেয়ে দেখি সেখানে ঐদিনে আমরা প্রথম ট্যুরিস্ট। সোনমার্গ ভ্যালি পুরো বরফে ঢাকা। কিছু হোটেল আছে যেগুলোর দরজা স্নো পড়ে বন্ধ হয়ে আছে। কিছু লোক সেগুলো কেটে হোটেলে ঢোকার রাস্তা করছে। একটি হোটেলে সকালের নাশতা করে ফেললাম। এখানে স্নো বাইকে চড়লাম যেগুলো এতদিন মুভিতে দেখেছি। চমৎকার থ্রিলিং ছিল। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সোনমার্গ থেকে ফিরে এলাম শ্রীনগরে। এদিন হযরতবাল মসজিদ এবং মোগলদের তৈরি বিখ্যাত বাগানগুলো দেখলাম। বিখ্যাত টিউলিপ বাগানও দেখলাম। ডাল লেকের চারপাশে গাড়ি নিয়ে ঘুরলাম। ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে এলাম।
হাসপাতালের পাশে একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় জানলাম সে হোটেলে ফ্রি ওয়াইফাই আছে।
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা। অনেক বড় ও নামকরা রেস্টুরেন্টেও ওয়াইফাই নেই কাশ্মিরে। নতুন এই রেস্টুরেন্টটা হয়ত ফ্রি ওয়াইফাই দিয়ে কাস্টমার আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। এবং আমরা চরমভাবে আকর্ষিত হলাম। আমি সাধারণত ফ্রি ওয়াইফাই এড়িয়ে চলি, কিন্তু এখানে আর কোন উপায় ছিল না, যেহেতু মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। রেস্টুরেন্টটি আমাদের হোটেল থেকে দূরে হওয়া সত্ত্বেও আমরা এখানে খেতে আসতাম শুধুমাত্র ফ্রি ওয়াইফাইয়ের জন্য। আস্ত একটা মুরগির অর্ডার দিতাম এখানে। খেতেও ভালো লাগত, খাবার ভালো ছিল। ফ্রি ওয়াইফাই পেয়ে সারাদিনের সকল যোগাযোগ সেরে নিতাম এখানে বসে।

সফরের নবম দিন। এদিন গেলাম পাহেলগামে। পাহাড়ের ওপর একটা ভ্যালি আছে মিনি সুইজারল্যান্ড নামে। পাহাড়ের দুর্গম পথ ধরে ঘোড়ার পিঠে বসে যেতে হয় সেখানে। খরচ অনেক বেশি হলেও থ্রিলিং ছিল ঘোড়ায় চড়ে জার্নিটা। ঘোড়াগুলো ট্রেনিং প্রাপ্ত। পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে খুব সহজেই ঘোড়াগুলো পার হয়ে যায়। পাহেলগাম সফর শেষে ফিরে চললাম শ্রীনগরের দিকে। এদিন কিছু কাশ্মিরের বিখ্যাত ড্রাই ফ্রুটস (যা দেশে এসে খেয়েছি, একটুও ভালো লাগেনি ) ও কয়েকটা কাশ্মিরের বিখ্যাত শাল কিনলাম বাসার লোকদের জন্য।
সফরের ১০ম দিন। এদিন গেলাম গুলমার্গে। শ্রীনগর থেকে প্রায় ৫১ কিলো দূরে। এখানে আছে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম গন্ডোলা যা গুলমার্গ গন্ডোলা নামে পরিচিত। আমরা যাকে ক্যাবল কার নামে চিনি। ২টি ফেজ আছে এর। ১ম ফেজ ২৬০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতায় যায়। বেশির ভাগ (প্রায় ৯০%) ট্যুরিস্ট এই পর্যন্ত যায়। আর ২য় ফেজ আপনাকে পৌঁছে দেবে ৩৭৪৭ মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে বরফের মধ্য দিয়ে হেঁটে পাহাড় ক্লাইম্ব করে ৪২০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছালে আফারওয়াত পিক। এর ৮ কিলো দূরে পাকিস্তান। উচ্চতা অনেক হওয়ার কারণে এখানে বায়ু চাপ কম এবং অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। ক্যাবল কার থেকে নেমে বাকি পথটুকু বরফের মধ্য দিয়ে হেঁটে পৌছেছিলাম আফারওয়াত পিকে। এখানে একটু হাঁটলেই শরীর ক্লান্ত হয়ে যায় অক্সিজেন কম থাকার কারণে, গলা শুকিয়ে যায় আর্দ্রতা কম থাকার কারণে। ব্যাক সময় প্রথম ফেজের ওখানে নামলাম। কিছু খাওয়া-দাওয়া করলাম। এক বাংলাদেশী পরিবারের সাথে দেখা হলো। কথা বলে পরিচিত হলাম। তারা অবশ্য ২য় ফেজে যায়নি। এখানে স্কি করার জন্য চমৎকার জায়গা। কিছু লোককে স্কি করতে দেখলাম। ঘোরাঘুরি শেষে আবার শ্রীনগর ফিরে এলাম। হোটেলে পৌঁছে ড্রাইভারকে পুরোপুরি বিদায় দিয়ে দিলাম। কারণ আমাদের আর গাড়ির দরকার হবে না।
১১তম দিন। এ দিন আমরা পুরো ফ্রি। কাশ্মিরের সকল স্পট দেখা হয়ে গেছে। আমার বাকি দুই বন্ধুর কাছ থেকে আলাদা হয়ে ভাবলাম একা একা শ্রীনগর হেঁটে হেঁটে ঘুরব। কাশ্মিরের লোকদের দেখব। তাদের সাথে কথা বলবো। তো একা পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম। মোটামুটি সারা দিন শ্রীনগর ঘুরলাম গুগল ম্যাপ ইউজ করে। ডাল লেকের চারপাশে ঘুরলাম। কাশ্মিরের বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বললাম।
কাশ্মির একটা সীমিত মাত্রার যুদ্ধক্ষেত্র। যে কোন সময় সমস্যা হতে পারে। আর আমরা যে সময়ে গেছিলাম সে সময় কাশ্মির পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল। কাশ্মিরি এক যুবককে গাড়ির সামনে বেঁধে মানব ঢাল হিসেবে ইউজ করার ঘটনাটা ঐ সময়ের। ঐ এলাকা দিয়ে গুলমার্গ যেতে হয়। রাস্তায় অনেক ইটপাটকেল পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। লোকজনের মুখে ছিল চাপা আতঙ্ক আর ক্ষোভ।
রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে ফেরার পথে এক অটো ড্রাইভার আমাদের বাংলাদেশী পরিচয় পেয়ে খুব উৎফুল্ল হলো। সে বলল, আগে কখনও বাংলাদেশী দেখেনি। অটো ড্রাইভারটা স্মার্ট এক ইয়ং যুবক। হাতে স্মার্ট ফোন, কানে হেডফোন গোঁজা। আমাদের বয়সী মনে হলো। সে বলল আপনারা আগে আমার বন্ধু, তারপর কাস্টমার। সে পরদিন সকালে তার বাড়িতে আমাদের ইনভাইট করল। কিন্তু পরদিন আমরা কাশ্মির ত্যাগ করছি তাই যাওয়া হয়নি। এর পরে কাশ্মিরে গেলে তার বাসায় থাকার আমন্ত্রণ জানাল। কাশ্মিরের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জব এর অবস্থা ভালো নয় বিধায় এরকম অনেক স্মার্ট ছেলেদের অটো চালাতে দেখা যায়। সে এক অ্যাডভেঞ্চার বয়। সে সাইকেল চালিয়ে শ্রীনগর থেকে লেহ এবং শ্রীনগর থেকে মুম্বাই গেছে। তার মোবাইল নাম্বার দিল আমাদের। ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে ফেললাম তার সাথে। মাঝে মাঝে তার সাথে মেসেজ চালাচালি হয়। সঙ্গত কারণে তাকে ট্যাগ করলাম না এখানে।
সফরের ১২তম দিন। এদিন কাশ্মির থেকে কলকাতা যেতে হবে, শ্রীনগর থেকে কলকাতা বাই এয়ার। আবার দিল্লিতে প্রায় ৩ ঘন্টার ট্রানজিট আছে। শ্রীনগর এয়ারপোর্টের নাম শেখ উল আলম ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। নামে ইন্টারন্যাশনাল হলেও আসলে কোন ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট নেই।
হজের সময় কিছু ফ্লাইট সরাসরি এখান থেকে যায় বিধায় নাম ইন্টারন্যাশনাল হয়েছে। এদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। হোটেল চেকআউট করে বেরিয়ে পড়লাম। অসুস্থ বন্ধুকে শেষবারের মত হাসপাতালে নিয়ে গেলাম ইনজেকশন দেয়ার জন্য। হাসপাতালের পাশে সেই রেস্টুরেন্টটা বন্ধ পেলাম। সকালের খাবার এয়ারপোর্টে গিয়ে খাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা অটো ঠিক করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হলাম। এখানে একটা ভুল করেছি। শ্রীনগর এয়ারপোর্ট হাইসিকিউরড এয়ারপোর্ট। অটো নিয়ে এয়ারপোর্টে ঢোকা যায় না। এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় এক কিলো দূরে নেমে যেতে হয় অটো নিয়ে গেলে। শুধু গাড়ি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে পারবে। বিষয়টা আমরা জানতাম না।
তবে মজার বিষয় হলো, এয়ারপোর্টের কিছু আগে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ি আমাদের থামাল। আমাদের অফার করল সে আমাদের ফ্রি এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। আসলে তার এয়ারপোর্ট থেকে এক প্যাসেঞ্জার পিকআপ করার কথা। কিন্তু কোনো যাত্রী ছাড়া খালি গাড়ি এয়ারপোর্টে ঢুকতে দেয় না। আমরা তার গাড়িতে চড়ে বসলাম। এই এয়ারপোর্টে কয়েক দফা চেকআপ হয় এবং কোন হ্যান্ডব্যাগ সাথে রাখা যায় না। সব ব্যাগই চেকড লাগেজ হিসেবে দিতে হয়। ল্যাপটপ, ক্যামেরা ব্যাগ হাতে রাখা যায়, তাও কঠিন চেকআপের পর। এয়ারপোর্টের এক কিলো দূরে প্রাথমিক চেকআপ। গাড়ি থেকে লাগেজসহ নেমে স্ক্যান ও গাড়ি সার্চ করা হলো। অটোতে আসলে এখানে অটো ছেড়ে দিয়ে বাকিটুকু হেঁটে যেতে হতো। এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম। যদিও আমাদের ফ্রি অফার করেছিল তবুও ড্রাইভারকে ১০০ রুপি দিলাম। এরপর ২য় চেকআপ। কয়েক দফা চেকআপ হলো। বোর্ডিং পাস নিয়ে লাগেজ চেকইন করার পরও এয়ারপোর্টের মধ্যে লাগেজ রাখার জায়গায় যেয়েও লাগেজ কনফার্ম করে আসতে হয়। আমার ক্যামেরা আমার হাত ব্যাগে ছিল। হাতে রাখা ব্যাগের সব কিছু বের করে ম্যানুয়ালি ভালো করে চেক করে দেখে। সর্বশেষ বিমানে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে বিমানের দরজায়ও একবার চেকআপ করে।
বিমানে দিল্লি নামলাম যেহেতু দিল্লিতে ট্রানজিট ছিল। দিল্লির তাপমাত্রা তখন প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিমানের দরজা থেকে বের হওয়ার সাথেই মনে হলো মুখ পুড়ে গেছে গরমে। পানির বোতল বের করে মুখ ধুয়ে ফেললাম। দিল্লি এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক লাউঞ্জে প্রবেশ করে মনে হলো এটা এয়ারপোর্ট নয়, এটা একটা শপিং মল। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম আসলে শপিং মল নয় এটা বিশাল একটা বার। লোকজন দেদার মদ গিলছে, আর সেলফি তুলছে। মাস্যাজ পার্লারও আছে এক চিপায়।
দিল্লি এয়ারপোর্টে একটা বিষয় দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। দিল্লি এয়ারপোর্ট হলো নো সাউন্ড জোন।
শব্দদূষণ হবে বলে বিমানের আসা যাওয়ার সময় অ্যানাউন্স করা হয় না। কিন্তু বারগুলোকে হাই ভলিউমে মিউজিক বাজাতে দেখলাম। নো সাউন্ড জোন কই গেল? লাউঞ্জে তাবলিগ জামাতের কিছু লোকের সাথে দেখা হলো, সম্ভবত তারা নাইজেরিয়ান। আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে কলকাতা যাবে। পরদিন বাংলাদেশ আসবে।
দিল্লি থেকে কলকাতার প্লেনটা অনেক লেট ছিল। আমাদের পাশের সিটে কলকাতার এক ভদ্রলোক বসল। হাতে লম্বা একটা বোতল প্যাকেট করা, এয়ারপোর্ট থেকে কিনেছে। সাথে তার ছেলেও আছে। সংস্কৃতিতে আমাদের দেশের সাথে অনেক পার্থক্য বোঝা গেল। এয়ারপোর্টে এত সিকিউরিটি দেখা হয়, কিন্তু এই মদের বোতলটা যে একটা মারণাস্ত্র হতে পারে তা এদের কে বুঝাবে! রাত ১০টার দিকে কলকাতা পৌঁছুলাম। বেশি রাত হয়ে গেছে দেখে অনলাইনে হোটেল বুকিং দিয়ে ফেলেছিলাম দিল্লি থাকতেই। একটা ট্যাক্সি নিয়ে বুক করা হোটেলে চলে গেলাম।
সফরের ১৩তম দিন। ভোরেই ঘুম থেকে উঠে বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা হলাম। ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করে দুপুরের আগে প্রবেশ করলাম বাংলাদেশে। শেষ হলো ১৩ দিনের এক দীর্ঘ সফর। আলহামদুলিল্লাহ্!

 

Share.

মন্তব্য করুন