‘অন্তু, বাজান কই গেলি? এই অন্তুকে নিয়া আর পারন যায় না। এইমাত্র স্কুল থেইক্যা আইলো, আবার কই যে গ্যাছে!’
সে সময় মা, মা বলে অন্তু বাড়ির ভেতর ঢোকে।
-কিরে অন্তু স্কুল থেইকা আইসা কই গেছিলি।
-মা আমি বাপজানরে আগাইতে গেছলাম।
-তা পরেও পারতি, আগে কয়ডা খাইয়া নিবি।
– ‘মা দ্যাহ, এই গরমের দিনে কত কষ্ট কইরা বাপজান মাঠে কাম করে, আমি যদি বাপজানের সাথের জিনিসগুলান আগায়া আনতে পারি। তয় বাজানের কষ্ট অনেক কমবো। এই কথা বলতে বলতে অন্তু তার কাঁধের বস্তগুলান নামায়।’
-‘বুঝছি, তয় তুমিও তো বাজান অনেক দূর থেইক্যা পইড়া আস। টিফিন খাওয়ার জন্য কয়ডা টাহা তো দিতে পারি না। কত কষ্ট কইরা পড়ালেহা কর।
-‘না মা, এ আর কী কষ্ট, তোমরা সবার জন্য এর চেয়ে বেশি কষ্ট কর।’
অদূরে বারান্দায় বসে অন্তুর মলিনমাখা মুুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজাম মিয়া। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেন তার অভাবও বেড়েছে। ছয়, ছয়টি ছেলে থাকতেও তার বৃদ্ধ বয়সে একটু বিশ্রাম নেই তার। জীবনের শেষ বিশ্রাম ছাড়া মনে হয় আর বিশ্রাম জুটবে না।
ছয় ছেলের মধ্যে অন্তু সবার ছোট। বাকিরা সব বিয়ে-শাদি করে যে যার মতো আলাদা। অভাবের সংসারে অন্যান্য ছেলেগুলোর পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না। যার কারণেও ছেলেরা নিজেদের নাজুক অবস্থার জন্য বাবাকে দোষী করে।
অন্তু ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর মেধাবী বলে অল্পদিনেই স্যারদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। অন্তুর বাবা-মায়েরই ইচ্ছা এই ছেলেটা অন্তত পড়ালেখা করুক। সমস্যা হচ্ছে তাদের বাড়ি থেকে হাইস্কুলটা অনেক দূরে। কাঁচাপাকা সড়ক। সাইকেল ছাড়া অন্যান্য যানবাহন তেমন চলে না। আর নিজস্ব কোন বাহন না থাকায় অন্তুকে বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরের স্কুলে হেঁটে যাওয়া আসা করতে হয়। তাতে কিছু মনে করে না সে। অন্তু ভাবুক ছেলে। যেতে যেতে গাছপালা আর সবুজ প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগে তার। ফুলপাখিদের সাথে কথা বলে। তাদের খবর নেয়। এভাবে একলা একলা সে স্কুলে যায়। তা ছাড়া তাকে তো অনেক বড় হতে হবে। বাবা আর কত কাজ করবে, তার তো একটু বিশ্রাম দরকার। এই ভেবেও মনকে সান্ত¡না দেয়। বাবার চোখে পানি দেখে অন্তু দৌড়ে যায় বাবার কাছে। ছোট হাত দুটি দিয়ে দুচোখ মুছে দেয়।
Ñ বাজান তুমি কান্দ ক্যান?
-নারে বাপ কান্দি না। বাপ হইয়া আজ পর্যন্ত তোরে একটা সাইকেল কিইন্না দিতে পারি নাই, তাই নিজেরে ছোট মনে অয়।
অন্তুর বাপের কান্না দেখে অন্তুর মাও কেঁদে ফেলেন। কিছুক্ষণ এ বিলাপ চলতে থাকে।
-থাক বাজান আমার সাইকেলের দরকার নাই। চলেন আমরা অহন সবাই মিলে ভাত খাই।
আর এভাবে দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে গেল। অন্তু প্রথম স্থান অধিকার করে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন বছরের ক্লাস। আবারও সেই হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায় সে। সকালবেলা কিছু পান্তা ভাত, কোনদিন জোটে আবার কোন দিন জোটে না। তাই খেয়েই স্কুলের দিকে ছোটে অন্তু। যতদিন যেতে থাকে অন্তুও মনে মনে তার স্বপ্নকে বড় করতে থাকে। স্বপ্ন একটাই, একটা সাইকেল। সে আশপাশের কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াতে শুরু করে দেয়। তাতে তার খাতাপত্র কেনা, পরিবারের জন্য বাজার করা, বাবাকে চা খেতে দেয়া সবকিছু চলে। এ ছাড়া এর মধ্যেই অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমাতে থাকে।
স্কুলের পথে যেতে যেতে এতিমের মতো অন্যদের পানে চায়। যদি কেউ তাকে একটু সাইকেলে তুলে নেয়। কিন্তু কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। এভাবে আরো একটি বছর পেরিয়ে যায়। অন্তু ক্লাস এইটে ওঠে। আবারও প্রথম হয়। আবারও সেইপথে একাকী পথচলা।
আজ বড্ড গরম পড়ছে।
‘-এই আসিফ একটু দাঁড়া আমি আর হাঁটতে পারছি না।’
-না হাঁটতে পারলে একটা সাইকেল কিনে ফেল না। পরের সাইকেলে যাওয়ার অত সাধ আসে কোথা থেকে। আসিফের এ অবন্ধুসুলভ আচরণে অন্তু কষ্ট পায়। আর কারও সাইকেলে যাবার ইচ্ছাও করে না ।
কিছুদিন পর অন্তুর বাবা অন্তুর জন্য একটা সাইকেল কিনে আনলো। তা দেখে অন্তুতো মহাখুশি। বাপজান আমার লাইগ্যা সাইকেল আনছো। অন্তুর চোখ দুটি পানিতে টলমল। ‘অন্তু বাজান তুমি কান্দ ক্যান।’ বাবার জিজ্ঞাসা। ‘না বাবা কান্দিনা, এটাতো আমার জন্য খুবই খুশির দিন।’ অন্তুর স্বপ্ন এতদিনে যেন পূরণ হলো। অন্তু পরদিনই সাইকেল নিয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু প্রথম দিনেই তাকে শুনতে হল অনেক কথা।
– ‘কিরে অন্তু সাইকেল কোথায় পেলি।’ আসিফ বলে।
-‘কারও কাছ থেকে ধার এনেছে নিশ্চয়, নয়তো কোথায় পাবে।’ কামালের জবাব।
আসিফ ও কামালের কটু কথায় অন্তু কিছু মনে করল না। কিন্তু প্রতিদিন এভাবে অন্তুকে নানা কথাবার্তা বলে তারা। একদিন
অন্তু স্কুলে বারান্দায় বসে কাঁদছিল। হঠাৎ রফিক স্যার এসে বললো, ‘কি অন্তু কি করছ? অন্তু স্যারের ডাকে পিছন ফিরে তাকাতেই রফিক স্যার তার চোখের দিকে তাকিয়ে হতবাক।
‘-একি অন্তু তুমি কাঁদছো!’
– কই স্যার, কিছু না কিছু না বলে অন্তু তা লুকোবার চেষ্টা করে। কিন্তু পাশে মনির স্যারকে সব খুলে বলে। রফিক স্যার সব শুনে আসিফ ও কামালকে অফিসে ডাকলো। তারা প্রকৃতপক্ষে খুবই দুষ্টু । তাই সব ছাত্রছাত্রীও তাদের একটা শাস্তির আশা করছে। রফিক স্যার সব ছাত্রছাত্রীকে যার যার ক্লাসরুমে যেতে বললেন। তারপর তাদেরকে ভালো করে বোঝালেন, ‘দ্যাখ- অন্তু তোমাদের বন্ধু এবং দরিদ্র পরিবারের ছেলে। তাকে তোমরা সমীহ করবে কি না, উল্টা তাকে নিয়ে মশকরা কর। ভেবে দ্যাখ তো, অন্তুর জায়গায় যদি তোমরা হতে কেমন লাগত তোমাদের। একসঙ্গে পড়াশোনা কর সবাই ভাই কিংবা বন্ধু। আজ যাও। এসব কাজ আর কখনো করবে না।’ স্যারের কথা শুনে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ পর তারা দুজন স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলে স্যার তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নেন। এরপর থেকে আসিফ ও কামাল কারো সাথে আর কোনদিন খারাপ আচরণ করেনি।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও স্কুল ছুটির পর অন্তু বাড়ি ফিরে যায়। বাড়িতে এত মানুষ কেন! ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখে তার বাবা বিছানায়। বাজান বলে একটা চিৎকার দেয় অন্তু। না অন্তু তোমার বাজানের তেমন কিছু অয় নাই, তুমি কোনো চিন্তা কইরো না, কাম করতে করতে হঠাৎ মাথা ঘুইরা পইড়্যা যায়। তারপর আমরা বাড়িতে নিয়া আসি। পাশ থেকে দাঁড়ানো লোকগুলো বলতে থাকে। অন্তু আর কোন কথা বলে না। শান্ত হয়ে রয় কিছুক্ষণ। সেদিনের পর থেকে অন্তুদের সংসারে আরও দুর্দশা নেমে আসে। আস্তে আস্তে অন্তুদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। অন্তুর বাবা আরও অসুস্থ হয়ে যায়। ঘরে কোন টাকা-পয়সাও নেই। যা ছিল সব শেষ। মাত্র অন্তুর সাইকেলটা রয়েছে শেষ সম্বল। মা অন্তুর মুখের দিকে তাকালেন। তাকাতে গিয়ে চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। না এসব আমি কি ভাবতাছি। অনেক কষ্টে অন্তুর সাইকেলটা কেনা অইছে আর অহন, না…না…
অন্তু যেন সুবোধ বালকের মতো বুঝল সব।
-বাজানের অসুখ সারাইতে এহনও অনেক টাহা-পয়সার দরকার তাই না মা। তার মা কথা বলে না। অন্তু আবার বলে, আমরা না হয় আমাগো সাইকেলটা বেইচা ফেলি। না, বাবা এ কথা কইচ না, সঙ্গে সঙ্গে অন্তুর মায়ের প্রতিবাদ। মাগো বাজানের থেইক্যা আমার সাইকেলটা বেশি মূল্যবান না। আর বাজানের অসুখ সারলে না হয় আবার একটা কিন্না দিও। এ কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে অন্তু। শেষমেশ উপায় না দেখে অন্তুর সাইকেলটা বেচতে হলো। ভোরের আবছা অন্ধকার কেটে পূর্বদিকের সূর্যটা হেসে উঠেছে। শুরু হয়েছে নতুন দিন। অদূরে বারান্দায় যেন সাইকেলটা হেলান দেয়া রয়েছে, অন্তু প্রতিদিনের অভ্যাসমত বলতে থাকে, ‘মা ছেঁড়া কাপড়টা কই? সাইকেলটা তো মুছতে হবে। স্কুলের সময় হয়ে গেছে। ধুর আমিযে কি বোকা, সাইকেল তো আর নেই অন্তু বলতে থাকে অবলীলায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার মা সেসব দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি মুখে আঁচল গুঁজে ঘরের ভিতর ছুটে গেলেন। কদিন সাইকেল পাওয়াটা স্বপ্নের মতো ছিল। যেন ঘুম ভেঙে যাওয়ায় স্বপ্নটাও ভেঙে গেছে। কপালে থাকলে আবার সাইকেল হবে। মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে অন্তু। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্কুলের পথে পা বাড়ায়।

Share.

মন্তব্য করুন