বাসার কথা শুনলেই আমাদের যে কারোই কেবল পাখির বাসার কথা মনে হয়। কিন্তু পাখিরা ছাড়াও এ বিশাল প্রাণিজগতের অনেক প্রাণীই বাসা বানায়। এরা মেরুদন্ডী প্রাণীও হতে পারে আবার অমেরুদন্ডী প্রাণীও হতে পারে। পিঁপড়ে বাসা করে। মৌমাছি বাসা করে, ব্যাঙ বাসা করে এমনিভাবে কুমির, কচ্ছপ, পাখিসহ নানা বন্য প্রাণীরা বাসা নির্মাণ করে। বাসা নির্মাণ করি আমরা মানুষেরা। এ বাসা নির্মাণ করা প্রাণীদের সহজাত আচরণগুলোর মধ্যে অন্যতম। মূলত এসব প্রাণী ভালোভাবে বেঁচে থাকতে বা টিকে থাকতে এসব বাসা নির্মাণ করে। ডিম বা বাচ্চা দেয়া থেকে শুরু করে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন বা জন্ম দেয়া, ছোট ছোট বাচ্চাদের নানা প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে বড় করে তুলতে প্রাণীরা বাসা নির্মাণ করে তথা বাসাগুলোকে ব্যবহার করে। কিন্তু আমার অতি আপন সোনামণিরা! তোমরা কি জান এ ক্ষেত্রে স্বাদুপানি, আধালোনা পানি বা সাগরের পানির ভেতর বসবাসকারী নানারকম মাছও পিছিয়ে নেই। এসব মাছও পানির ভেতর বাসা নির্মাণ করে ডিম দেয়, বাচ্চা ফুটায় এবং ফুটানো বাচ্চাদের বড় করে পরম মমতায়। এ লেখাটিতে আমি তোমাদের পানির ভেতর বসবাসকারী কয়েকটি মাছের বাসা সম্পর্কে সামান্য একটু জনিয়ে দেবো। তার আগে আমরা জেনে নেই মাছ আসলে কী, কাকে বলে। মাছ হলো শীতল রক্তবিশিষ্ট পানির মেরুদ-ী প্রাণী যারা ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায় এবং রশ্মি বা কাঁটাযুক্ত বিভিন্ন পাখনার সাহায্যে পানিতে চলাচল করে।
এসব মাছের বাসা নির্মাণ অনেকখানি নির্ভর করে তাদের ডিমের সংখ্যা বা ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যার ওপর। একটি কথা বলি- তোমরা লক্ষ করবে যেসব প্রাণীর ডিমের সংখ্যা বা বাচ্চার সংখ্যা অনেক বেশি তাদের ডিম বা বাচ্চার প্রতি যত্ন কম। অনেক সময় নেই বললেই চলে। আর যাদের ডিমের সংখ্যা বা বাচ্চার সংখ্যা কম তাদের ডিমের প্রতি বা বাচ্চার প্রতি যত্ন বেশি। যেমন মানুষেরা সাধারণত একটি করে বাচ্চার জন্ম দেয়। এতে বাচ্চার প্রতি যত্ন থাকে হাজার হাজার গুন বেশি। আমরা বেড়ে উঠি বাবা মায়ের অনেক আদর মমতা ও ভালোবাসায়। আবার মাছদের মধ্যে এমন অনেক মাছ আছে যারা লাখ লাখ ডিম দেয় তারা এসব ডিমের কোনো যত্ন নেয় না, বাচ্চারও কোনো যত্ন নেয় না।
তবে সোনামণিরা! যেসব মাছের ডিমের সংখ্যা কম তথা বাচ্চার সংখ্যা কম সেসব মাছ তাদের ডিম ও বাচ্চার যত্ন নেয়। আর যতœ নিতে গিয়ে তারা নির্মাণ করে পানির ভেতর বাসা।
যেমন স্বাদু পানির ফলি বা ফলুই মাছ বর্ষাকালে ৩০০০টির মত ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার আগে ফলি মাছ পানিতে থাকা নানা আগাছার মধ্যে আগাছা দিয়ে বাসা নির্মাণ করে তাতে ডিম পাড়ে। এদের ডিমগুলো আঠালো হয়। ফলে আগাছার সাথে আটকে থাকে। বাবা ফলি ও মা ফলি দু’জনেই বাসায় ডিম পাহারা দেয়।

পানির আগাছাসহ ফলি মাছ
আবার স্বাদু পানির টাকি, গজার, শোল এসব মাছ আগাছা দিয়ে ভাসমান বাসা নির্মাণ করে। বিশেষ করে গজার মাছ এভাবে বাসা নির্মাণ করে তাতে গোলাপি হলুদ ডিম ছাড়ে। একটি মা গজার ৫০০টির মত ডিম ছাড়ে। বাবা-মা দু’জনেই বাচ্চা -৫-১০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে হওয়া পর্যন্ত পাহারা দেয়। বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

বাচ্চাসহ গজার মাছ
টাকি মা মাছ ৩০,০০০ ডিম ছাড়ে। এরা মানুষের তৈরি বিভিন্ন প্রশস্ত কংক্রিটের সুড়ঙ্গ এর মধ্যে বিভিন্ন আগাছা দিয়ে বাসা তৈরি করে ডিম ছাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ বাসার মাঝখানে থেকে ডিম দেয়। মা-বাবা মিলে অথবা একজনে ডিম পাহারা দেয় বা বাচ্ছা পাহারা দেয়।

বাচ্চাসহ টাকি মাছ
আগামীর মৎস্যবিদ বন্ধুরা! মূলত বাসা নির্মাণকারী মাছগুলোর অধিকাংশই সামুদ্রিক। কিছু আছে উপকূলীয় অঞ্চলের। আবার কিছু আছে বদ্ধপানির। এসব কয়েকটি মাছের বাসা সম্পর্কে কিছু কথা লিখেই আজকের লেখটি শেষ করতে চাই। যেমন-
১. থ্রি স্পাইন স্টিকল ব্যাক (Three spined stickle back) :
এ মাছটি বসন্তকালের প্রথম দিকে এবং গ্রীষ্মকালে সাধারণত ডিম দেয়। এদের মধ্যে পুরুষ মাছটি ভেতরের দিকে ফাঁপা বাসা তৈরি করে। বাসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে সামুদ্রিক গাছপালা বা পানির বিভিন্ন ডালপালাসহ শাখা- প্রশাখা যুক্ত শৈবাল। এগুলো দিয়ে ফাঁপাযুক্ত বাসা বানিয়ে এর ওপর নিচে পুরুষ মাছটি আঠালো এক জাতীয় পদার্থ তৈরি করে বাসাটিকে মসৃণ ও সুন্দর করে। এরপর জিগজ্যাগ নাচ প্রদর্শন করে স্ত্রী মাছকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। স্ত্রী মাছ বাসার ভেতর ৪০-৩০০টি ডিম ছাড়ে। পুরুষ মাছ ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে এবং ডিমগুলোকে পাহারা দেয়।

থ্রি স্পাইন স্টিকল ব্যাক মাছের বাসা
২. চিকলিড ফিশ (Cichlid fish) :
এ মাছটি পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন লেকে বসবাস করে এবং ডিম ছাড়ার সময় বাসা বানায়। এদের বাসাটি অনেকটা বড় ধরনের। গভীরতাও বেশি। অনেকটা নৌকার মত। এখানে স্ত্রী মাছ ডিম পাড়ে।

চিকলিড ফিশের বাসা
৩. ওয়াস ফিশ (Wrasse fish) :
এটি সামুদ্রিক মাছ। এটি কাঁটাযুক্ত পাখনাওয়ালা উজ্জ্বল বর্ণের বুদ্ধিমান মাছ। এরা বড় ধরনের সাজানো বাসা তৈরি করে। এরা ডিম ও বাসা পাহারা দেয়। বাসার উপকরণ হিসেবে সামুদ্রিক বিভিন্ন উদ্ভিদের অংশ উল্লে¬খযোগ্য।

ওয়াস ফিশের বাসার উপকরণ সংগ্রহ এবং নিচে বাসা

৪. ক্লন ফিশ (Clown fish) :
পুরুষ ক্লন ফিশ বিভিন্ন পাথর ও কোরালের আশপাশে বাসা বানায়। স্ত্রী মাছ ১০০-১০০০টি ডিম দেয়। পুরুষ মাছ ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের না হওয়া পর্যন্ত পাহারা দেয়। এদের বাচ্চা ফুটে বের হতে ৪-৫ দিন সময় লাগে।

ক্লন ফিশের বাসা
৫. সান ফিশ (Sun fish) :
প্রায় সকল ধরনের সান ফিশই বাসা নির্মাণ করে। পুরুষ সান ফিশ বহুকষ্টে করে বিভিন্ন ধরনের শৈবাল ও জৈব আবর্জনা বাসা করতে জড়ো করে। এদের বাসা সাধারণ ও পিরিচ বা ডিশ আকৃতির হয়।
এসব বাসা এরা বসন্তকালের শেষের দিকে করে। সাধারণত পুকুর, লেক, স্রোতযুক্ত নদী ইত্যাদি স্থানে এরা বাসা নির্মাণ করে।
ডিম পাহারা দেয় এরা। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর এরা বাসা ছেড়ে চলে যায়।

 

সান ফিশের বাসা
৬. বেটা মাছ (Dwarf gourami ) :
বেটা মাছগুলো বাবল নেস্ট (ইঁননষব) বা বুদ বুদ সৃষ্টি করে বাসা নির্মাণ করে। অনেক সময় এরা বুদ বুদের সাথে ভাসমান উদ্ভিদ, উদ্ভিদের অংশ ব্যবহার করে থাকে।
এ বাসাতে এরা ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা না বের হওয়া পর্যন্ত পুরুষ মাছ এ বাসা পাহারা দেয়।

বেটা মাছের বাসা বেটা মাছসহ বাসা
৭. ফাফার ফিস (Puffer fish) :
ফাফার ফিস (Puffer fish) বড় ধরনের গোলাকার বাসা নির্মাণ করে। যাতে স্রোতযুক্ত পানিতে ডিমগুলো হারিয়ে না যায়। পুরুষ মাছটি পুরা বাসাটি ডিমের জন্য পাহারা দেয়।

ফাফার ফিশ ও এর বড় বাসা
৮. ব্লু আকারা, ট্রুফিক্যাল ফিশ(Blue acara tropical fish):
এসব মাছগুলো স্পঞ্জের মধ্যে বাসা নির্মাণ করে। বাসাগুলো দেখতে গোলাকার।
বব্লু আকারা, ট্রুফিক্যাল ফিশের বাসা
৯. ব্ল্যাক স্যাডলেড টবে ফিশ (Black suddled tobe fish):
স্ত্রী ও পুরুষ মাছ এক সাথে বাসা নির্মাণ করে এবং এতে এরা ডিম ছাড়ে পাহারা দেয়।
ব্ল্যাক স্যাডলেড টবে ফিশের বাসা

আগামীর গবেষক বন্ধুরা তোমরা দেখলে তো- কেবল পাখিরাই বাসা বাঁধে না, মাছেরাও পানির ভেতর বাসা বাঁধে। ডিম ও বাচ্চার যত্ন নেয়। আর এসব কিছুর মধ্যেই রয়েছে শিল্পের বিষয়, চিন্তার বিষয়, সৃষ্টিকর্তাকে বোঝার বিষয়।

Share.

মন্তব্য করুন