আরবি বছরের বারোতম মাস জিলহজ। আল্লাহপাক ও তাঁর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ঘোষণাকৃত চারটি হারাম বা সম্মানিত মাসসমূহের অন্যতম মাস এটি। ইমলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি হলো হজ। আর এই মাসে আল্লাহতাআলা হজ আদায়ের ফরজটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ঈদুল আজহা শব্দ দু’টি মূলত আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। আসলে এটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ত্যাগ করা।

আসুন আমরা এই আজহা বা কুরবানির বৈশ্বিক রূপ জেনে নেই! হিব্রু ভাষায় কুরবান শব্দটি ‘নিকটে আসা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ইসলাম ধর্মে কুরবানি হলো ত্যাগ বা উৎসর্গ। আবার ‘আজহা’ শব্দটি কুরবানি বা উৎসর্গ অর্থেও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ‘ঈদুল আজহা’ ত্যাগের উৎসব অর্থে ব্যবহার করা হয়। ঈদুল আজহাকে ঈদুল কুরবান বা ঈদুল কুবিরও বলা হয়।

পবিত্র কুরআনের সূরা আল বাকারার ১৯৬ নম্বর আয়াতে ঈদ উদযাপনের মূল ভিত্তি দেখতে পাওয়া যায়। সূরা মায়েদাতে ‘ঈদ’ শব্দটি দেখতে পাওয়া যায়, যার অর্থ হলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। তাই ইবনুল আরাবি বলেছেন, ঈদ নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে তা প্রতি বছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে।
বাংলা, উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি এবং মালয়ি ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অস্ট্রোনেশিয় ভাষায় আত্মত্যাগের আরেকটি আরবি শব্দ কুরবান ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে ঈদুল আজহাকে বলা হয় কুরবানির ঈদ। আফগানিস্তান ও ইরানে বলা হয় ঈদে কুরবান। চীনা ভাষায় ঈদুল আজহাকে বলা হয় কুরবান জিয়ে আর উইঘুররা বলেন কুরবান হেইত। মালয়েশীয় ও ইন্দোনেশীয়রা বলেন, হারি রাইয়া কুরবান।
তুর্কিরা বলেন, কুরবান বাইরামি, আজারি ও তাতারিরা, বসনীয় ও ক্রোয়েশীয়রা একই কথা বলেন। ইয়েমেন, সিরিয়া ও মিসরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে বলা হয় ঈদুল কবির। কোন কোন স্থানে বকরা ঈদও বলা হয়। নাইজেরিয়া, সোমালিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও ঈদুল আজহার ভিন্ন ভিন্ন জনপ্রিয় নাম রয়েছে। জার্মানিতে ঈদুল আজহাকে বলা হয় অপফেরফেস্ট আর হাঙ্গেরিতে বলা হয় আলদোজাতি উন্নেপ।

বিখ্যাত আরবি অভিধান দআল মাওরিদদ এ ঈদ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে ভোজ, ধর্মোৎসব, পর্ব, তীব্র আনন্দ, ভূরিভোজন করা, ভোজ দেয়া, ভূরিভোজন করানো, পরিতৃপ্ত করা ইত্যাদি। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য দাওয়াত। বিধায় ঐদিন হলো ভূরিভোজনের সুযোগ, বেশি বেশি করে খাওয়ার দিন, রোজা না রাখার দিন।

এ দিনটিতে মুসলমানেরা তাদের সাধ্যমত শরিয়তের বিধানানুযায়ী উট, গরু, দুম্বা কিংবা ছাগল কুরবানি করে ত্যাগের দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে থাকে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিখ্যাত কবিতা কুরবানিতে বলেন, ‘তাই জননী হাজেরা বেটারে পরালো বলির পূত বসন/ওরে হত্যা নয় আজ, সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ এখানে কবি পরম সত্যের অনুসারী মানব-মানবীর প্রেম শক্তি অবগুণ্ঠন করে মহাকৃতজ্ঞতা উদ্গীরিত হয়ে আত্মিক অনুপ্রেরণায় মুসলিম জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন।

কুরবানির ঈদের উৎস অন্বেষণে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত ইবরাহিম (আ)-কে স্বপ্নে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কুরবানি করার নির্দেশ দেন। এই আদেশ অনুযায়ী হজরত ইবরাহিম (আ) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করার জন্য প্রস্তুত হলে আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে ইসমাইল (আ)-কে সরিয়ে নেন ও জান্নাতি এক দুম্বা শিশু ইসমাইলের পরিবর্তে কুরবানি হয়ে যায়। সেই প্রিয় পুত্রের পরিবর্তে পশু কুরবানির নির্দেশ দেন আল্লাহ পরবর্তীতে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করে। জিলহজ মাসের দশম দিন হচ্ছে ঈদুল আজহার দিন।
এ দিনের মরতবা অপরিসীম। এ দিন সূর্যোদয়ের পরে ২ রাকাত ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করতে হয়। এবং নামাজ শেষে শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি দিতে হয়।

মহান আল্লাহর আহ্বানে জনক-জননী তাঁদের ঔরসজাত সন্তানকে উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি। স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির এই অফুরন্ত প্রেম-ভালোবাসা চিরজাগ্রত হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। তাই আজো তারই ধারাবাহিকতা অব্যাহত।

কুরবানিকে আরবি ভাষায় ‘উযাহিয়্যা’ বলা হয়। উযাহিয়্যা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ওই পশু, যা কুরবানির দিন জবেহ করা হয়। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট সময়ে পশু জবেহ করাকে কুরবানি বলা হয়। এটি একটি আর্থিক ইবাদত। যার কারণে সবার ওপরই কুরবানি করার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই যাদের ওপর কুরবানি আদায় করা আবশ্যক তাদের উচিত নির্দিষ্ট নিয়মে ও নির্দিষ্ট সময়ে পশু কুরবানি দেয়া। তবে কুরবানির মূল উদ্দেশ্য যেহেতু নিজেদের পশুত্বপ্রবৃত্তির কুরবানি করে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করা সেহেতু এই উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের গৌরব-মর্যাদার প্রতীক হিসেবে কুরবানিকে বিবেচনা করা উচিত নয়। বর্তমান সময়ে অনেকেই কুরবানির মাধ্যমে নিজের আর্থিক সামর্থ্য জাহির করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিযোগিতাপ্রবণ কুরবানির কোনো মূল্য নেই আল্লাহর কাছে। মহান আল্লাহ কেবল ওই কুরবানিকেই কবুল করে থাকেন, যেটা কেবলই তাঁরই প্রেম-ভালোবাসায় হয়ে থাকে।

প্রাক-ইসলামী যুগে মানুষ পশু কুরবানি করার পর কুরবানির পশুর গোশত আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদন করার জন্য কাবাঘরের সামনে এনে রেখে দিত, পশুর রক্ত কাবার দেয়ালে লেপ্টে দিত। সূরা হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে এ কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে সু¯পষ্টভাবে বলা হয়েছে- কুরবানির পশুর রক্ত-মাংসের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই; তিনি যা চান তা হলো কুরবানিকারীর খোদাভীতি, আল্লাহর প্রতি একান্ত আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস-চিত্তের একাগ্রতা।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজকাল কুরবানির পশু ক্রয় করা হয় প্রতিযোগিতা করে এবং কুরবানি করার দৃশ্য ভিডিও করা হচ্ছে। অথচ শরিয়তে এগুলো হারাম। আজকাল দেখা যায় বেশির ভাগ মানুষ লৌকিকতার ইবাদত করছে অর্থাৎ লোক দেখানোর ইবাদত করছে। মনে করছে যদি সে ৫টি গরু কুরবানি করে, তবে মানুষ তার কথা বেশি উচ্চারণ করবে। কিন্তু এগুলো হারাম। বাজারের সব থেকে দামি গরুটা কে কিনবে এই প্রতিযোগিতা যে আমাকে সবাই চিনবে ও জানবে। আমরা এত দাম দিয়ে কুরবানির পশু ক্রয় করেছি লিখে সেই পশুর সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছি। যদি কোন মানুষ নিজের যশ-খ্যাতি লৌকিকতা ইত্যাদির নিয়ত কওে, তাহলে উক্ত কুরবানি আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে না।

আবার বর্তমানে দেখা যায়, মানুষ কুরবানি করে ফ্রিজের মধ্যে ভরে রাখে। গরিব মিসকিন যারা আছে তাদেরকে তা বণ্টন করতে দ্বিধাবোধ করে। এটা ঠিক নয়। কুরবানির পশুর গোশত হলো গরিব মিসকিনদের। তাদের হক মোতাবেক আদায় না করলে কুরবানি দুরস্ত হবে না। কুরবানিদাতা কুরবানি দেয়ার পর গোশত তিনভাগ করে এক ভাগ নিজে, এক ভাগ গরিব মিসকিনকে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে বণ্টন করে দিতে হবে। এটা সুন্নত পন্থা।

এই ঈদুল আজহা উৎসব-আনন্দেরও। এ আনন্দের ধারা আমরা লক্ষ্য করি সর্বত্র। বিশেষ করে তোমাদের মতো শিশু-কিশোরদের মধ্যে বাঁধভাঙা জোয়ার দেখা দেয়, যা নির্মল আনন্দেরই প্রকাশ। দাদা-বাবাদের সাথে কুরবানির পশুর হাটে যাওয়া। পশু কিনে এনে সেটির আদর-আর্তি করা। খড়কুটো-পাতা ইত্যাদি খাওয়ানো। সবাই মিলে কুরবানি দেয়ার পর সেই গোশত গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলানোতে তারা চরম আনন্দ পায়। বন্ধুরা, ঈদের আনন্দ যেন সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এ জন্য আমাদের নতুন জামা প্রতিবেশী নিঃস্ব-দুস্থ শিশুদের মাঝে ভাগ করে নেব। তাহলে কুরবানির ত্যাগের মহিমায় আমাদের কোমল হৃদয়টিও ভরে যাবে।

Share.

মন্তব্য করুন