ঈদ মানে আনন্দ। মুসলিম সমাজের ধর্মীয় উৎসব। এই আনন্দ ছোট-বড়, ধনী-গরিব সকলের জন্যই সমান। আমাদের সমাজ ও পারিবারিক জীবনে ঈদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। ঈদকে কেন্দ্র করেই পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয়। সবাই গ্রামের বাড়িতে একত্র হয়। এতে শিশুদের জন্য পরিবারের চাচা-চাচি ফুফু-ফুফাসহ অন্যদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আনন্দ উৎসবের অন্যরকম মাত্রা নিয়ে শিশু কিশোরদের জীবনে ঈদ আসে। ঈদ হলো খুশির দিন। প্রতি বছর সবার জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে ঈদ। শিশুর মাঝে ঈদ আসা মানে হরেক রকম আনন্দের পসরা বয়ে যাওয়া। ঈদের নানারকম বিচিত্রতা আছে আমাদের ছোট বড় সবার জীবনে। গ্রামের ঈদ, শহুরে ঈদ। নানা বর্ণে নানা সাজে যুগ পরম্পরায় ঈদের পরিবর্তন ঘটেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর থেকেই মুসলমানদের জীবনে ঈদের সওগাত নেমে আসে। পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলেই ঈদের রমরমা আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। ফিরনি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে। তবে ঈদের অসীম আনন্দের ছ’টা শিশুদের জন্যই বিশাল রকমের আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে আনে। ঈদের ঝলমলে আনন্দ ধনী-গরিব সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে নেয়ার মাধ্যমেই ঈদের মূল ভাবার্থটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ঈদকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়েই সুখ ও আনন্দের সওগাত পরিবেশন করে।
ইসলাম ধর্মে শরিয়তের বিধান নামাজ পড়া, রোজা রাখা। প্রকৃত শরিয়ত পালনের জন্য নামাজ যেমন মুসলমানদের জন্য আল্লাহতায়ালা ফরজ করেছেন ঠিক সেভাবে সিয়াম সাধনার মাস হিসেবে আখ্যা দিয়ে আল্লাহ পবিত্র রমজান মাসে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে পরিশুদ্ধ আত্মসংযমের কথা বলেছেন। একটি মাস নামাজ পড়ার পাশাপাশি সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারসহ সকল প্রকার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সিয়াম সাধনা করতে হয়। তারপরই ঈদের সার্থকতা আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
এক মাস সফল সাধনার পর ঈদের মূল সুর বেজে ওঠে তখনই, যখন চাঁদ ওঠে আকাশে। পাক-ভারত উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে/ এলো খুশির ঈদ।/আপনাকে তুই বিলিয়ে দে/ শোন আসমানী তাগিদ।’/গানটি ধ্বনিত হয় আকাশে বাতাসে। মিডিয়াগুলো ওই একটি ইতিহাস খ্যাত গানের সুরধ্বনিতে ঈদের আগমনবার্তা প্রকাশ করে। ছেলে বুড়ো সবার মধ্যে শুরু হয়ে যায় ঈদের ধুম। শিশুরা মাতোয়ারা হয়ে এখানে সেখানে হইচই হট্টগোলে মাতিয়ে রাখে প্রকৃতিকে।
ঈদের কোনো ভেদাভেদ নেই, কী ধনী কী গরিবে। ঠিক তেমনি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ছোঁয়া আজাকাল গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও ভর করেছে। গ্রামের ঈদ আর শহুরে ঈদের মধ্যে কিছু পার্থক্য তো ছিলোই। বর্তমানে সে পার্থক্য ধীরে ধীরে কমছে।
ঈদকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের ঘরে ঘরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে এ ঘর থেকে ও ঘর ছুটে যাওয়ার সেই সব চেনা জানা সরল দিনগুলো এখন অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে বলা চলে। গ্রাম গঞ্জের ঈদ আজো এতো বিলাসবহুল হয়ে ওঠেনি। সচরাচর গ্রামের লোকজন অধিকাংশই কৃষিজীবী। ফলে ঈদ পালন করতে হলে একসময় তাদের ফসল উৎপাদনের ওপর নির্ভর করতে হতো। কৃষকের ছেলেমেয়েরা ঘরে ফসল উঠলে পরেই ঈদের নতুন জামা কিনতে পারে। নইলে বছর ভেদে চান রাতে ছেলেমেয়েরা পুরনো জামাকাপড় নতুন করে কেচে অথবা ঘষে মেজে পরিষ্কার করে ঈদের উৎসবে মেতে ওঠার পর্ব সেরেছে। তবে গ্রামের ঈদে এখনো দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের দল ছুটে চলে এ পাড়া ও পাড়া, এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে কিংবা দূর গ্রামের কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। ঈদ সেলামির পাশাপাশি সেমাই, ফিরনি রান্না করা ভালো খাবার দাবার তো থাকছেই। এছাড়া মজার ব্যাপার হলো গ্রামে ঈদের আয়োজনে থাকে নানা পণ্য ও খেলাধুলা সমাদৃত গ্রাম্যমেলা। এ মেলা বসে নদীতীরে, গ্রাম্য হাটে, বটতলায়, স্কুল মাঠে। মেলার মধ্যে থাকে লোকজ হাতের তৈরি নানা সামগ্রী। নকশি করা পাখা, পুতুল, রঙিন হাঁড়ি, মিঠাই, বাঁশের বাঁশি ইত্যাদি। হা-ডু-ডু, ফুটবল, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবাঁধা, ফুটবল-ক্রিকেট ইত্যাদি ম্যাচ আয়োজনে ঈদকে করে বড়ই প্রাণবন্ত। আরো আছে নাগরদোলা, ঘোড়ার দৌড়, নৌকা বাইচ, মারফতি ও মুর্শিদি গানের জমজমাট আসর। তবে, নগর সভ্যতার ছোঁয়া পেয়ে আজকাল গ্রামের সেইসব ঐতিহ্যবাহী দৃশ্যাবলি অনেকটা কমতে শুরু করেছে।
শহুরে ঈদ মানে ফাঁকা নগর, যানজট কোলাহলমুক্ত সুনসান পরিবেশ। আর এ ফাঁকা নগরীর ঈদের দিনটির জন্য অপেক্ষমাণ থাকে বিলাসিতার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো বিত্তশালী বাবার ছেলেমেয়েরা। ফলে শহরের উন্নত জীবনব্যবস্থার আদলে গড়ে ওঠা ধনী লোকদের ছেলেমেয়েদের শপিং মল থেকে বড় বড় বিপণিকেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়া, জমকালো বাহারি পোশাক আশাক, প্রসাধনী কিনতে লাখ লাখ টাকার ব্যয়ভার তো আছেই। প্রয়োজনে কাপড় কেনার জন্য বিদেশে গিয়ে হাল ফ্যাশনের কাপড়ে বন্দী হবার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে শহুরে ঈদের আয়োজনে আয়োজক ধনীদের ছেলেমেয়েরা। আর ফুটপাথে ও বস্তিতে থাকা হাজার হাজার নগরবাসী শিশুর ঈদও কাটে অন্য এক বৈচিত্র্যময়তায়। হকার মার্কেটের সহজলভ্যতায় কেনা কাপড় কিংবা ধনীদের জাকাত ফিতরার টাকায়। তাদেরও ঈদ দলবেঁধে ছুটে চলা সেলামি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। শহুরে ঈদে প্রত্যেক বাড়িতে পোলাও, কোরমা, কাচ্চি বিরিয়ানি, ফিরনি, পায়েস, জর্দা, চিকেন ফ্রাই, পিজা, মোগলাই, কোপ্তা নানাজাতের মিষ্টিসহ উপাদেয় মসলায় হরেক রকম আধুনিক বিলাসী খাবারের সমাবেশ থাকে। সেলামির আয়োজন সর্বত্র আছে বিধায় নগরের শিশুরাও ব্যতিক্রম থাকে না। ছেলেমেয়েরা সেলামি সংগ্রহের জন্য দলবেঁধে ছুটে, বিলাসবহুল গাড়িতে, না হলে ভাড়া করা গাড়িতে চলে অভিযান। তবে সত্যিকার ঈদের মাহাত্ম্য হওয়া উচিত ধনী-গরিব সবার জন্য সমান। বর্তমান বিদ্যমান সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইসলামের সাম্য-সমতা শান্তির বাণী ও বৈষম্যহীন চেতনায় ভাস্বর আনন্দময় ঈদের কথা ভাবতে হবে সবার জন্য।
আগেই বলেছি, ঈদুল ফিতর প্রাচীন বাংলার উৎসবগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে। যদিও এদেশে ঈদ প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে এর গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। তবুও বলা যায়, আজ আমরা অধীর আগ্রহে যে ঈদ উৎসবের আমেজের জন্য অপেক্ষা করে থাকি এদেশে সে ইতিহাসের সূচনা হয় প্রায় ৮০ থেকে এক শ’ বছর আগে। ফরায়জী আন্দোলনের পর মুসলমানরা প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে জানতে পায়। ওই সময়ের ইংরেজ আমলে বড়দিনই ছিলো প্রধান উৎসব। মুসলমানরা যখন রাজনীতি ও বিদ্যাবুদ্ধির দিকে সচেতন হয়ে ওঠে তখন থেকেই ঈদ উৎসব গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর বাংলাদেশে দু’টি ঈদই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। সেই থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হয়। সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের বাণী, শুভেচ্ছা বিনিময়, বিবৃতির মাধ্যমে সকল নাগরিকের মধ্যে ঈদ উৎসব হয়ে ওঠে আলাদা মর্যাদায় মহিমান্বিত।
অবশেষে ২৯-৩০ রোজা ইফতার শেষের সন্ধ্যাবেলা ছোট বড় সকলের চোখ স্থির হয়ে হানা দেয় পশ্চিম আকাশের দিকে। অগণিত শিশু-কিশোর তরুণ নগর গ্রাম সর্বত্র হই হল্লা করে চাঁদ দেখার নেশায় পাগলপারা হয়ে ওঠে। বাড়ির খোলা ছাদে, অবারিত খেলার মাঠে শুধু উৎসুক লোকের চোখ এই বুঝি দেখা দিলো আকাশে শাওয়ালের চাঁদ। যখনই সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটে তখনই ঈদের সাজ সাজ রব ওঠে সর্বত্র। একমাস সিয়াম সাধনার পরে রোজাদাররা আনন্দের অপেক্ষায় থাকে সেই চান রাত থেকেই পরদিন সকালে গোছল করে নতুন জামা কাপড় গায়ে জড়িয়ে সুগন্ধি আতর লাগিয়ে কখন ঈদগাহে যাবে। আর শিশুদের তো পোয়া বারো। আনন্দে মশগুল হয়ে চান রাত থেকেই মহা হইচই উৎসবে মেতে ওঠে। শিশু-কিশোরদের এ আনন্দ শেষ হতে চায় না কোনোভাবে। রমজানের রোজা শেষে এক ভিন্ন সুখের মাত্রায় শিশুরা খুঁজে পায় ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম চেতনা। যেখানে সবাই একযোগে মেতে ওঠে আনন্দের সওগাতে। সাম্য ও মিলনের আনন্দের সেই সুর শিশু-কিশোরসহ সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে পবিত্র ঈদুল ফিতরের চাইতে বড় উৎসব কী করা যায়?
ঈদের যে মহান শিক্ষা, সেই শিক্ষায় আমাদের গোটা জীবনকে রাঙিয়ে তুলতে হবে। সাজিয়ে তুলতে হবে সুন্দর- সৌরভে। ঈদের দিনের ন্যায় বছরের প্রতিটি দিন আসুক আমাদের জীবনে। ঈদের খুশি ও আনন্দে কাটে যেন আগামীর প্রতিটি মুহূর্ত। ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়ুক ঘরে ঘরে। আর ঈদের দিনের ন্যায় ধনী-গরিব সকলে মিলে যেন সব সময় এক সাথে চলতে পারি।
দেশে দেশে ঈদ আয়োজনের ভিন্নতা থাকলেও সব দেশেরই মুসলমানদের মাঝে ঈদের এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যবহ। সব দেশই মুসলিম রীতিনীতি অনুযায়ী এই দিনটি পালন করলেই কিছু সাংস্কৃতিক আবেশও এখানে চলে আসে। মুসলমানদের প্রধানতম এই দিনটি হোক সব মত ও পথের মানুষের মিলনমেলা, উৎসব হোক সার্বজনীন।

 

Share.

মন্তব্য করুন