এক সময়ের কথা। এক দেশে বাস করত এক বুড়ো আর বুড়ি। তারা ছিল অত্যন্ত গরিব। কোন রকমে তাদের দিন কাটত। সারা বছর পেট পুরে খেতেও পারত না। পরার কাপড়ও ছিল শত ছিন্ন। যে ঘরটিতে তারা বাস করতো সেটিও ছিল জরাজীর্ণ। একদিন বুড়ি বুড়োকে বলল- আজ রান্নার জন্য ঘরে এক টুকরো কাঠও নেই। তুমি এখনই বনে যাও। সেখান থেকে কিছু কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে এসো।
বুড়ো বলল- বনে গেলেই কাঠ পাওয়া যাবে?
বুড়ি বলল- তুমি তাহলে কুড়ালটি নিয়ে যাও। সেখানে গেলে তুমি অনেক ছোট ছোট গাছ দেখতে পাবে। তার মধ্যে যেটি খুশি সেটিকে কেটে নিয়ে এসো। ওই কাঠ দিয়ে রান্নার কাজ করবো। খাবার-দাবার গরম করতে পারবো।
অগত্যা বুড়ো ঘর থেকে তার কুড়ালটি নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি বনের দিকে রওনা হলো। বনের ভেতর ঢুকে সে একটি ছোটখাটো ঝাঁকড়া বুনো আপেল গাছ দেখতে পেলো। এই গাছটি সে কাটবে স্থির করলো। বুড়ো তার কুড়ালটি উঁচিয়ে যেই-না গাছের গায়ে কোপ দিতে গেল অমনি বুনো আপেল গাছটি স্পষ্ট মানুষের গলায় কথা বলে উঠলো। রীতিমতো মানুষের মত আর্তনাদ করে উঠলো।
গাছটি করুণ স্বরে বলল- আমাকে দয়া করে কেটে ফেলো না ভালো মানুষের ছেলে। আমি অবশ্যি একদিন তোমার উপকার করবো।
কথা শুনে বুড়ো লোকটি এত ভয় পেল যে, তার হাত থেকে কুড়ালটি গেল পড়ে। ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। গাছটি মানুষের স্বরে কথা বলায় সে ভয়ানক ভয় পেয়ে গেল। এক মুহূর্ত সেখানে দেরি না করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলো বুড়ো।
বাড়িতে ফিরে বুড়ো বনের ভেতর যা যা ঘটেছে সবই বুড়িকে খুলে বললো। সব শুনে বুড়ি ভয়ানক রেগে গেল।
বুড়ি বললো- তোমার মতো আহম্মক আমি জীবনেও দেখিনি। তুমি এখনি ওই আপেল গাছটির কাছে যাও। গিয়ে বলো- একটি ঘোড়ার গাড়ি এবং একটি তেজি ঘোড়া যেন গাছটি আমাদের দেয়। সারা জীবনটা কি পায়ে হেঁটে হেঁটে সমস্ত জায়গায় ঘুরবো?
: তোমার যেমন ইচ্ছা। এই বলে মাথায় টুপিটি দিয়ে বুড়ো আপেল গাছের উদ্দেশে রওনা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বুড়ো আপেল গাছের কাছে পৌঁছে গেল। গাছের কাছে গিয়ে বুড়ো বললো- ওহে আপেল গাছ শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?
গাছটি জবাব দিলো- হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। আমাকে কি তুমি কিছু বলতে এসেছ?
বুড়ো বললো- আমার স্ত্রী তোমার কাছে একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি ও একটি তেজি ঘোড়া চেয়েছে।
আপেল গাছ উত্তর দিলো- আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়ে দেখবে তুমি যা চাইছো তাই তোমরা পেয়েছো।
বুড়ো তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাড়ির সামনে গিয়ে দেখে কি অবাক কা-! বাড়ির সামনে তেজি ঘোড়াসহ একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘরের দরোজার একেবারে সামনে মুখ গোমড়া করে বুড়ি দাঁড়িয়ে।
বুড়ো বললো- কি হলো? তুমি অমন করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
বুড়ি বললো- তুমি ভেবে দেখ। আমাদের অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে তাই না? কিন্তু এখন আমার ভয় হচ্ছে আমাদের এই নড়বড়ে বাড়িটাই না একসময় ভেঙে পড়ে। তুমি আবার আপেল গাছটির কাছে যাও। আর আমাদের জন্য একটা সুন্দর বাড়ি চাও। সে আমাদের একটি সুন্দর বাড়ি দিয়েও দিতে পারে।
লোকটি তখন আবার আপেল গাছটির কাছে গেল। আর বুড়ির ইচ্ছানুযায়ী একটি নতুন বাড়ি চাইল।
আপেল গাছ সব শুনে বললো- আচ্ছা ঠিক আছে। তাই হবে। তুমি বাড়ি যাও।
বুড়ো লোকটি যখন ফিরে এলো তখন সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাদের জরাজীর্ণ কুটিরের জায়গায় নয়নাভিরাম এক বাড়ি দেখতে পেল সে। সুন্দর বাড়িটি পেয়ে বুড়ো আর বুড়ির আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু এসব পেয়েও বুড়ি সন্তুষ্ট হলো না।
বুড়ি এবার তার স্বামীকে বললো- তুমি এখনি সেই আপেল গাছের কাছে যাও। তুমি গাছটির কাছে গিয়ে আমাদের জন্য গরু, ছাগল, ভেড়া আর কিছু হাঁস-মুরগি চেয়ে আনো। তাহলে আমাদের আর কোন কিছুর অভাব থাকবে না।
বুড়ো স্ত্রীর আর্জি নিয়ে আপেল গাছের কাছে গেল। সবকিছু শুনে এবারো আপেল গাছটি বললো- খুব ভালো কথা। ঠিক আছে তোমার বউয়ের ইচ্ছা পূরণ হবে। তুমি এবার বাড়ি যাও।
লোকটি বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ির উঠোন ভরা গরু, ছাগল, ভেড়া। তার পাশাপাশি অনেক হাঁস-মুরগি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। এসব দেখে বুড়োর মন খুশিতে ভরে উঠলো। সে বললো- যথেষ্ট হয়েছে আর আমাদের কিছুর দরকার নেই।
সাথে সাথে বুড়ি বলে উঠলো- না না এসব মোটেই যথেষ্ট নয়। তুমি আপেল গাছের কাছে যাও। গিয়ে বলো আমাদের প্রচুর সোনাদানা, টাকা-পয়সা চাই।
বুড়ো লোকটি বউ-এর চাহিদার কথা জানানোর জন্য আবারো আপেল গাছটির কাছে গেল। তারপর স্ব-সঙ্কোচে বউ-এর চাহিদার কথা জানালো।
আপেল গাছটি আগের মতই বললো- খুব ভালো কথা। বাড়ি যাও। তুমি যা চাইছো সবই পাবে।
বুড়ো বাড়ি এসে দেখে বস্তা ভরা স্বর্ণ মুদ্রা টেবিলের ওপর রাখা। বুড়ি বস্তা থেকে স্বর্ণ মুদ্রা বের করে গুনছে আর বিভিন্ন পাত্রে রাখছে। বুড়োকে দেখে বুড়ি বললো- যাক বাবা, এবার আমরা যথেষ্ট ধনী হয়েছি কি বল! কিন্তু শুধু ধনী হলে কি চলবে? লোকে যদি আমাদের ভয় না পায় তাহলে ধনী হয়ে কি লাভ? তুমি এখনই আপেল গাছটির কাছে গিয়ে বলো ঐ এলাকার সব লোক যেন আমাদের সমীহ করে ভয় করে। সেই রকম একটা ব্যবস্থা করে দেয়।
বুড়ো লোকটি এবারও আপেল গাছটির কাছে গিয়ে স্ত্রীর আর্জি জানালো। আপেল গাছ সব শুনে আবারও তার ইচ্ছা পূরণ করলো।
বাড়ি এসে লোকটি দেখতে পেল তার বাড়ির চারপাশ দিয়ে অসংখ্য সৈন্য অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে আছে।
বুড়ো তার স্ত্রীকে বললো- আশা করি এর চাইতে আমাদের আর বেশি কিছুই চাইবার নেই। আমাদের এখন সবকিছু হয়েছে কি বলো!
বুড়ি রাগে গজগজ করে উঠলো। বললো- না না এখনো আমাদের সবকিছু হয়নি। তোমাকে আর একবার আপেল গাছের কাছে যেতেই হবে।
বুড়ো সাথে সাথে বলে উঠলো- আমি আর আপেল গাছের কাছে গিয়ে কিছুই চাইতে পারব না। এটা ঠিকও হবে না।
বুড়ি বুঝলো বেশি জোরাজুরি করা ঠিক হবে না। তার চেয়ে মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে বুড়োকে আপেল গাছের কাছে পাঠাতে হবে। বুড়ি তার স্বামীকে নানাভাবে বুঝিয়ে আপেল গাছের কাছে যাওয়ার জন্য রাজি করালো। বুড়ি তার স্বামীকে বললো- তুমি আপেল গাছের কাছে গিয়ে বলো- সে যেন এই এলাকার সকল লোককে আমার দাস-দাসী বানিয়ে দেয়। আমাদের যেহেতু সব কিছু আছে তখন এ ছাড়া আমাদের আর কিই বা চাইবার আছে বলো।
এই কথা শুনে বুড়ো মনে মনে বেশ চটে গেল। কিন্তু বুড়িকে সাহস করে কিছুই বলতে পারল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে আপেল গাছটির কাছে আবার গেল। তারপর সে তার বউ-এর চাহিদার কথা গাছের কাছে জানালো।
বুড়োর কাছে সব শুনে এই প্রথম আপেল গাছ বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বললো- তোমারও কি একই ইচ্ছা! তাড়াতাড়ি বলো।
বুড়ো বললো- না আমার এই ইচ্ছা নয়। এলাকার সব লোককে আমি আমার বউয়ের দাস-দাসী বানাতে চাই না।
আপেল গাছ বললো- এ যাবৎ শুধু তোমার বউয়ের ইচ্ছার কথা আমার কাছে বলেছ। তা আমি পূরণ করেছি। এইবার তোমার ইচ্ছার কথা বলো। আমি সেটি পূরণ করতে চাই।
বুড়ো খুশি হয়ে বললো- তাহলে আমার ইচ্ছার কথা শোন। আমি আমাদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।
আপেল গাছ বললো- ঠিক আছে। তোমার এই ইচ্ছাটা পূরণ হবে। বাড়ি ফিরে যাও তুমি। তুমি খুব ভালো মানুষ। বলে আপেল গাছটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
বুড়ো তখন ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে এসে দেখে চারিদিক সুনসান ঘোড়ার গাড়ি, নতুন বাড়ি, উঠোন ভরা গবাদি পশু, সৈন্য-সামন্ত সব বাতাসে মিলিয়ে গেছে। শুধু সেখানে আছে নিজেদের সেই জরাজীর্ণ কুটির। আর তার পাশে ছেঁড়া পোশাক পরা বুড়িটা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে।

Share.

মন্তব্য করুন